মাদ্রাসা কী? মাদ্রাসার পাঠক্রম ও শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করো। মুসলিম যুগে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কেন

মাদ্রাসা
মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসা ছিল উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান। অভিজাত মুসলিম সম্প্রদায় বা সম্রাট দ্বারা মাদ্রাসা পরিচালিত হত। মাদ্রাসাগুলি মসজিদ অথবা সমাধি সংলগ্ন অংশে গড়ে ওঠত। মাদ্রাসাগুলি বেশিরভাগ ছিল শহরে। দিল্লি, আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি, জৌনপুর, শিয়ালকোট, এলাহাবাদ, গোয়ালিয়র, লাহোর, থানেশ্বর, কাশ্মীর প্রভৃতি স্থানে অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পাঠক্রম
মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দুই ধরনের পাঠক্রম অনুসরণ করা হত-
ধর্মীয় শিক্ষার পাঠক্রম এবং ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষার পাঠক্রম। ধর্মীয় শিক্ষার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি ছিল- ধর্মতত্ত্ব ও কোরান পাঠ, কোরানের ব্যাখ্যা, হজরত মহম্মদের বাণী আলোচনা, ইসলামীয় আইন, হাদিস ও তার ব্যাখ্যা ইত্যাদি। ধর্মনিরপেক্ষ পাঠক্রমে সাহিত্য, জমি-জরিপ, ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, নীতিশাস্ত্র, দেহবিজ্ঞান, গণিত, জ্যামিতি, প্রকৃতিবিজ্ঞান, শিল্প ও ভাস্কর্য ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্রাট আকবরের সময় হিন্দু কৃষ্টি ও সংস্কৃতি যেমন- ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, বেদান্ত, পতঞ্জলি ইত্যাদি পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছাড়া চিত্র, ভাস্কর্য, সংগীতের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
শিক্ষণ পদ্ধতি
(1) মাদ্রাসার শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল মৌখিক।
(2) মুখস্থ করার রীতি ছিল।
(3) শিক্ষকগণ বক্তৃতা পদ্ধতি প্রয়োগ করতেন।
(4) দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, তর্কবিদ্যা- ইত্যাদি বিষয়গুলি শেখানোর জন্য বক্তৃতা ও আলোচনার ব্যবস্থা ছিল।
(5) ব্যাবহারিক বিষয়সমূহের জন্য হাতেকলমে কাজ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হত।
(6) শারীরতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র- ইত্যাদি বিষয়গুলির ক্ষেত্রে সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষণ পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হত।
মুসলিম যুগে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতির কারণ
(1) রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক হিসেবে সম্রাটের একচ্ছত্র ক্ষমতা : ইসলামীয় শাসনে সুলতানের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন স্থাপিত হয়, তেমনই তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিক্ষার অবনতিও ঘটে।
(2) রাজনৈতিক অরাজকতা ও অনিশ্চয়তার যুগ: মধ্যযুগে বিশেষত 647 থেকে 1200 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছিল রাজনৈতিক দোলাচলতা ও অনিশ্চয়তার সময়কাল। রাজনৈতিক অস্থিরতা সাম্রাজ্যে গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছিল, যার প্রভাব পড়েছিল সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম সর্বত্র। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থাও যথেষ্ট অবহেলিত হয়েছিল।
(3) শিক্ষাব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা: মধ্যযুগীয় অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্ধকারময় অবস্থার সৃষ্টি হয়। পৃষ্ঠপোষক শ্রেণির উত্থানপতনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে আনুকূল্যের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। হিন্দু-মুসলমান উভয় শিক্ষাব্যবস্থাই সমানভাবে এই অরাজকতার ফল ভোগ করতে থাকে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, রাজকীয় আনুকূল্যের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল মুসলিম উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাই বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
(4) ধর্মীয় গোঁড়ামি : ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতা বহু ক্ষেত্রেই মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই শিক্ষা প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন ছিল না। হিন্দুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল অবহেলিত। ফলে মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থার সংকীর্ণ রূপ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
(5) নারীশিক্ষার অধোগতি : মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থায় নারীশিক্ষা বিশেষভাবে অবহেলিত হয়। বাল্যবিবাহ এবং নারীদের অবরোধ প্রথার ফলে নারীশিক্ষায় অধোগতি আসে। পর্দাপ্রথার প্রচলন নারীশিক্ষার পরিসরকে সীমিত করে দেয়। ফলে সামাজিক রক্ষণশীলতা শিক্ষাগত ক্ষেত্রেও রক্ষণশীলতার সৃষ্টি করেছিল। তাই বলা যায়, সমগ্র মধ্যযুগের এই সর্বাঙ্গীণ অরাজকতা, শিক্ষাক্ষেত্রে দৈন্যদশা, গতিহীনতার ফলে জীবনের সকলক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তার ফলে মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছিল। যদিও এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শিক্ষার অগ্রগতি কিছুটা হলেও সম্ভব হয়েছিল।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর