মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষা কেমন ছিল-সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষা কেমন ছিল-সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থা

মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষা কেমন ছিল-সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো
মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষা কেমন ছিল-সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

(1) শিক্ষার উদ্দেশ্য: মধ্যযুগের হিন্দুশিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মের ধারা বজায় রেখে হিন্দু শিশুদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদান করা।

(2) হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: সাধারণভাবে হিন্দু শিক্ষা এসময় মুসলিম শাসকদের রাজকীয় আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত ছিল। তবুও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচীন হিন্দু শিক্ষার কেন্দ্রগুলি তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠশালাগুলি এবং উচ্চশিক্ষার কেন্দ্ররূপে টোল ও চতুষ্পাঠীর ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় পরিব্রাজকদের বিবরণ থেকে জানা যায়, মিথিলা, মথুরা, প্রয়াগ, হরিদ্বার, অযোধ্যা প্রভৃতি বহু স্থানে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র বা চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

(3) শিক্ষকদের ভূমিকা: মধ্যযুগীয় হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যথা-পাঠশালায় মন্দিরের পুরোহিত অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ছিল যথেষ্ট। বড়ো নগরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত পাঠশালাগুলিতে সাধারণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা শিক্ষাদান করতেন।

(4) শিক্ষার সুযোগ লাভ : হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পরিচালিত পাঠশালাগুলিতে একমাত্র শূদ্র ছাড়া অন্য সকল বর্ণের শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণ করতে পারত। তবে যেসকল পাঠশালায় বৌদ্ধ পণ্ডিতরা শিক্ষা দিতেন, সেখানে সকল বর্ণের শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণ করতে পারত।

(5) পাঠশালার শিক্ষণ পদ্ধতি: হিন্দু শিক্ষার প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান পাঠশালাগুলিতে শিক্ষণীয় বিষয়গুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ধর্মশাস্ত্র, ভাষা, সাহিত্য প্রভৃতি। আবৃত্তি পদ্ধতির মাধ্যমে মূলত শিক্ষাদান করা হত।

(6) উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান টোল ও চতুষ্পাঠীর শিক্ষণ পদ্ধতি: ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য প্রভৃতি ছিল উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র-টোল ও চতুষ্পাঠীর পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়বস্তু। এ ছাড়া ব্যাকরণ, স্মৃতি, কাব্য প্রভৃতি বিষয়েও শিক্ষাদান করা হত। টোল ও চতুষ্পাঠীর শিক্ষার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা।

(7) শিক্ষার পাঠক্রম : পাঠশালাগুলিতে তিন বছরের প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন ছিল। পাঠক্রমের মধ্যে ছিল ভাষা, সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, গণিত ও  প্রাথমিক হিসাবশাস্ত্র। মূলত আবৃত্তির মাধ্যমে পাঠদান করা হত। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা দেওয়ার জন্য টোল ও চতুষ্পাঠীগুলির পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল বেদ, উপনিষদ, সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, গণিত, শারীরতত্ত্ব, ব্যাকরণ, কাব্য ও ছন্দ।

(৪) শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক: মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক খুবই মধুর ছিল। শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব কম থাকায় ওই সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে শিক্ষার সুযোগ লাভ করত।

(9) মূল্যায়ন পদ্ধতি: মধ্যযুগীয় হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের জন্য শিক্ষক পরীক্ষা গ্রহণ করতেন এবং উপযুক্ত বিচার করে তার শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে বলে ঘোষণা করতেন।

(10) উপাধিসমূহ: মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থার বিশেষ প্রতিভাবান ছাত্ররা উপাধ্যায়, সার্বভৌম, মহামহোপাধ্যায়, দ্বিবেদী, ত্রিবেদী ইত্যাদি উপাধি  লাভ করত।

(11) শিক্ষার ব্যয়: রাজা, জমিদার বা অন্য কোনো ধনী ব্যক্তির দানের মাধ্যমে হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ব্যয় নির্বাহ হত। এ ছাড়া ইলতুৎমিস, আকবর, দারা শিকোহ্, হুসেন শাহ প্রমুখ মুসলিম শাসকরাও হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থ সাহায্য করতেন। মধ্যযুগে মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থা ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতির উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করায় হিন্দু শিক্ষা অবহেলিত হয়। তবে বলা যায়, বিভিন্ন ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্যেও হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থা স্তব্ধ না হয়ে তার গতি অব্যাহত রেখেছিল, কিন্তু সেই গতি ছিল মন্থর।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment