মধ্যযুগে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো

মধ্যযুগে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো

অথবা, মধ্যযুগের ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসার ভূমিকা আলোচনা করো।

অথবা, মাদ্রাসা কাকে বলে? ইসলামীয় শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসার ভূমিকা আলোচনা করো

মধ্যযুগে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো
মধ্যযুগে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো

মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসার ভূমিকা

মধ্যযুগে ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসার ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মাদ্রাসা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘dars’ থেকে যার অর্থ হল lecture বা lesson-এই প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল সাধারণত মসজিদকেন্দ্রিক। তবে মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চল ছাড়াও পৃথকভাবেও মাদ্রাসার অস্তিত্ব বজায় ছিল। মাদ্রাসার শিক্ষাকাল ছিল প্রায় দশ বা বারো বছর।

(1) উদ্দেশ্য: মাদ্রাসা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল-পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান পাঠ, অভিজ্ঞ আদর্শপরায়ণ ধার্মিক মানুষ সৃষ্টি এবং বাস্তবজীবনের উপযোগী নৈতিক শিক্ষা প্রদান।

(2) শিক্ষার মাধ্যম ও পাঠক্রম : আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে এখানে শিক্ষা দেওয়া হত। মুসলিম শিক্ষায় মাদ্রাসার পাঠক্রমের বিষয়গুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা হত। যথা-ইলাহি, রিয়াজি ও তাবিকি। এ ছাড়া ছাত্রদের সাহিত্য, ব্যাকরণ, ইতিহাস, দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, আইনশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে শিক্ষাদান করা হত।

(3) শিক্ষণ পদ্ধতি : মৌখিক পদ্ধতিতেই মাদ্রাসায় শিক্ষা দেওয়া হত। সাধারণত এখানে বক্তৃতা, মুখস্থ পদ্ধতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। মাদ্রাসার শিক্ষণ পদ্ধতিতে মনিটরিয়াল প্রথা বা সর্দার পড়ো প্রথা প্রচলিত ছিল। মেধাবী ও উচ্চতর শ্রেণির ছাত্ররা শিক্ষণে শিক্ষকদের সাহায্য করত। এ ছাড়া ধর্ম, তর্কশাস্ত্র, দর্শন ও রাজনীতির মতো বিষয়ে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে মাদ্রাসায় ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করা হত।

(4) অবৈতনিক ও আবাসিক: মাদ্রাসার শিক্ষা ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবৈতনিক ও আবাসিক। শিক্ষকরা ভাতা এবং ছাত্ররা বৃত্তি পেত।

(5) শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক: মাদ্রাসায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে পিতা- পুত্রের মতো সম্পর্ক ছিল।

(6) ডিগ্রি প্রদান: শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থাও এখানে ছিল। ধর্মতত্ত্বে বিশেষ পারদর্শীদের ‘আলিম’, তর্কবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্রে দক্ষতার জন্য ‘ফাজিল’ এবং সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতার জন্য ‘কাবিল’ ডিগ্রি দেওয়া হত।

(7) শৃঙ্খলা: মক্তবের মতো মাদ্রাসাতেও কঠোর শৃঙ্খলা ছিল। ইসলামের নির্দেশানুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়-নির্ঘন্ট অনুসারে নামাজ পড়া, পড়াশোনা করা, ধর্মীয় এবং সামাজিক কর্তব্যপালনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে নিয়মানুবর্তিতা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। অনৈতিক আচরণের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।

(৪) মাদ্রাসার অবস্থান: সাধারণত মাদ্রাসাগুলি মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকত। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসকগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত রাজধানীকে কেন্দ্র করে মসজিদের কাছাকাছি মাদ্রাসাগুলি গড়ে তোলা হত।

(9) পৃষ্ঠপোষকতা: রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো শিক্ষাবিভাগ না থাকায় মধ্যযুগে মাদ্রাসা প্রশাসনের দায়িত্বে থাকতেন বেসরকারি পরিচালন সংস্থা অথবা প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তিরা। আর্থিক অনুদান ছাড়াও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মাদ্রাসার জন্য জমি প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিল।

(10) সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি: শিক্ষার্থীদের চারুশিল্প ও হস্তশিল্প শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।

(11) শিক্ষার সময়সীমা: মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাক্রমের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। এটি ছাত্রদের মেধার উপর বিশেষত নির্ভর করত। সাধারণত কোনো ছাত্রের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য 15 বা 16 বছর লাগত। মধ্যযুগে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছিল। নানা উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের মধ্যে বিশেষ অবদান রেখেছে। মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রথমে মুসলিম শাস্ত্রাদি পাঠের ব্যবস্থা থাকলেও পরবর্তীকালে মাদ্রাসাগুলিতে হিন্দু শাস্ত্রাদিরও পাঠের ব্যবস্থা হয়েছিল। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সমন্বয়ী মনোভাব গঠনে সহায়ক উপাদান হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment