মধ্যযুগে ভারতের নারীশিক্ষা কেমন ছিল সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

মধ্যযুগে ভারতের নারীশিক্ষা কেমন ছিল, সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

মধ্যযুগে ভারতের নারীশিক্ষা কেমন ছিল সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো
মধ্যযুগে ভারতের নারীশিক্ষা কেমন ছিল সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

মধ্যযুগে ভারতের নারীশিক্ষা

(1) অন্দরমহলের শিক্ষা: মধ্যযুগে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে নারীশিক্ষা বিশেষভাবে অবহেলিত হয়। পর্দাপ্রথার প্রচলন সাধারণ নারীসমাজের শিক্ষার অধিকারকে সংকুচিত করেছিল। তবে, রাজপরিবার, অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা অন্দরমহলেই শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেত। অন্যদিকে হিন্দু উচ্চবংশীয় জমিদার ও অভিজাত পরিবারের মেয়েরাও গৃহেই পঠনপাঠনের সুবিধা পেত।

(2) প্রাথমিক শিক্ষার অপ্রতুলতা : মধ্যযুগে নারীদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই সামান্য। ‘কানুন-ই- ইসলাম’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় মেয়েরা সাত বছর পর্যন্ত মক্তবে ছেলেদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারত। এরপর তারা নারী হিসেবে পর্দার অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হত।

(3) সাহিত্য সংঘের ভূমিকা: ইসলামীয় শাসনে রাজপরিবারের বহু অভিজাত সদস্যদের উদ্যোগে সাহিত্যসংঘ-এর প্রতিষ্ঠা শিক্ষার অগ্রগতির পরিচয় বহন করে। এগুলি সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজপরিবারের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। রাজপরিবারের নারীরা সাহিত্যসংঘে যোগদানের মাধ্যমে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন বিদগ্ধ আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেত।

(4) নারী বিদ্যালয় স্থাপন: মধ্যযুগে বহু মুসলিম শাসকেরা ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে উঠে নারীদের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। জেনানা বিদ্যালয় বা নারীশিক্ষার পৃথক বিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে তারা নারীসমাজের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। সম্রাট আকবর স্ত্রী শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা স্থাপন করেন। সেখানে নারীরা কাব্য, সাহিত্য ও কলা, শিল্পের চর্চা করতেন।

(5) মুসলিম শাসকাদর উদ্যোগ: মুসলিম শাসকদের নারীশিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। যথা- মালওয়ার সুলতান গিয়াসুদ্দিন খলজি নারীশিক্ষা বিস্তারে সচেষ্ট হন। তাঁর হারেমে বহু শিক্ষিতা নারীর উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। সম্রাট আকবরও নারীশিক্ষা বিস্তারে বিশেষভাবে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে ফতেপুর সিকরিতে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

(6) বিদুষী নারীদের ভূমিকা: মধ্যযুগে রাজপরিবার ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের বহু উচ্চশিক্ষিতা মহিলা ছিলেন, যারা শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। যথা-ফতেমা, হামিদা, সোফিয়া প্রমুখ নারীরা মক্তব ও মাদ্রাসা স্থাপনে এবং লিপির উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষিতা নারীদের মধ্যে চাঁদ সুলতানা, নূরজাহান, জাহানারা প্রমুখের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মুঘল সম্রাট বাবরের কন্যা গুলবদন বেগম-এর ‘হুমায়ুননামা’ নামক গ্রন্থটি তার সাহিত্যিক প্রতিভার পরিচয় বহন করে। জেবউন্নিসা আরবি ও ফারসিতে সুদক্ষ ছিলেন। নূরজাহানও আরবি ও ফারসিতে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

(7) যুদ্ধবিদ্যা ও ভাষা শিক্ষায় দক্ষ নারীদের ভূমিকা: মধ্যযুগে নারীশিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বহু নারী এইসময় একাধারে যুদ্ধবিদ্যা ও অন্যদিকে ভাষা-সাহিত্যে প্রচুর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। এক্ষেত্রে দাক্ষিণাত্যের চাঁদ সুলতানার কথা বলা যায়। তিনি যুদ্ধবিদ্যায় সুদক্ষ ছিলেন এবং এর পাশাপাশি আরবি, ফারসি, মারাঠি প্রভৃতি ভাষায়ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। সুলতান ইলতুৎমিসের কন্যা রাজিয়া কোরানে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাপালন, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য রাজিয়া পরিচালনা ও ন্যায়পরায়ণতার ক্ষেত্রে একজন মহীয়সী মহিলা ছিলেন।

(৪) শিক্ষক: মধ্যযুগে উচ্চবংশের মেয়েদের অন্দরমহলে শিক্ষার জন্য ‘উলেমা’ এবং চারুকলা শিক্ষার জন্য ‘ওস্তাদ’ নিয়োগ করা হত। রাজপরিবারে মহিলাদের জন্য ‘শিক্ষিকা’ নিয়োগ করা হত। ঐতিহাসিকদের মতে, সুলতান গিয়াসউদ্দিন হারেমের মহিলাদের শিক্ষার জন্য শিক্ষিকা নিয়োগ করেছিলেন।

(9) নারীশিক্ষার আধাগতি : মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইসলামিক অনুশাসনে হিন্দুধর্ম ও সমাজ রক্ষণশীলতার আবরণে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে। ফলে হিন্দু নারীদের শিক্ষাও সংকুচিত হয়। কেবলমাত্র কিছুসংখ্যক বিত্তবান ও অভিজাত পরিবারে নারীশিক্ষার ক্ষীণ ধারা অব্যাহত থাকে।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment