মধ্যযুগে ইসলামীয় শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হত? মধ্যযুগের শিক্ষাকে ‘অন্ধকার যুগ’-এর শিক্ষা বলার কারণ কী

ইসলামীয় শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন
(1) পরীক্ষা ব্যবস্থায় অনুপস্থিতি ও ক্রমিক মূল্যায়ন: মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় অধুনা প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন ছিল না। শিক্ষক যখন মনে করতেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সেই স্তরের জন্য সম্পূর্ণ হয়েছে, তখনই তিনি তাদের পরীক্ষা নিতেন এবং পরবর্তী স্তরের জন্য নির্বাচন করতেন। অর্থাৎ ক্রমিক মূল্যায়ন পদ্ধতিই ছিল শিক্ষার্থীদের মেধা ও যোগ্যতা বিচারের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা।
(2) জুটি সংশোধন : শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক মূল্যায়নের জন্য মাঝে মাঝে তাদের প্রবন্ধ পাঠ, আলোচনা ও বিতর্কসভায় অংশগ্রহণ করতে হত। শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে তা আয়ত্ত করতে পারছে কি না, তা শিক্ষকরা বিচার করে দেখতেন। তাদের ত্রুটিগুলি পর্যালোচনা করে শিক্ষক তা সংশোধনে সাহায্য করতেন।
(3) ডিগ্রি প্রদান: শিক্ষা সমাপ্ত হলে যোগ্যতার বিচারে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদান করা হত। যথা- ধর্ম বিষয়ে পরাদর্শিতা অর্জনকারীদের ‘আলিম’, যুক্তিশিক্ষায় যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ‘ফাজিল’ ও সাহিত্যে দক্ষ শিক্ষার্থীদের ‘কাবিল’ এই উপাধি বা ডিগ্রি প্রদান করা হত।
মধ্যযুগের শিক্ষাকে অন্ধকার যুগ-এর শিক্ষা বলার কারণসমূহ
(1) রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক হিসেবে সম্রাটের একচ্ছত্র ক্ষমতা : ইসলামীয় শাসনে সুলতানের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন স্থাপিত হয়, তেমনই তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিক্ষার অবনতিও ঘটে।
(2) রাজনৈতিক অরাজকতা ও অনিশ্চয়তার যুগ: মধ্যযুগে বিশেষত 647 থেকে 1200 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছিল রাজনৈতিক দোলাচলতা ও অনিশ্চয়তার সময়কাল। রাজনৈতিক অস্থিরতা সাম্রাজ্যে গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছিল, যার প্রভাব পড়েছিল সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম সর্বত্র। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থাও যথেষ্ট অবহেলিত হয়েছিল।
(3) শিক্ষাব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা: মধ্যযুগীয় অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্ধকারময় অবস্থার সৃষ্টি হয়। পৃষ্ঠপোষক শ্রেণির উত্থানপতনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে আনুকূল্যের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। হিন্দু-মুসলমান উভয় শিক্ষাব্যবস্থাই সমানভাবে এই অরাজকতার ফল ভোগ করতে থাকে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, রাজকীয় আনুকূল্যের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল মুসলিম উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাই বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
(4) ধর্মীয় গোঁড়ামি : ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতা বহু ক্ষেত্রেই মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই শিক্ষা প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন ছিল না। হিন্দুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল অবহেলিত। ফলে মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থার সংকীর্ণ রূপ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাকার
(5) নারীশিক্ষার অধোগতি : মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থায় নারীশিক্ষা বিশেষভাবে অবহেলিত হয়। বাল্যবিবাহ এবং নারীদের অবরোধ প্রথার ফলে নারীশিক্ষায় অধোগতি আসে। পর্দাপ্রথার প্রচলন নারীশিক্ষার পরিসরকে সীমিত করে দেয়। ফলে সামাজিক রক্ষণশীলতা শিক্ষাগত ক্ষেত্রেও রক্ষণশীলতার সৃষ্টি করেছিল। তাই বলা যায়, সমগ্র মধ্যযুগের এই সর্বাঙ্গীণ অরাজকতা, শিক্ষাক্ষেত্রে দৈন্যদশা, গতিহীনতার ফলে জীবনের সকলক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তার ফলে মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছিল। যদিও এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শিক্ষার অগ্রগতি কিছুটা হলেও সম্ভব হয়েছিল।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর