মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো

মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থার কতকগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল পাঠশালা, টোল, চতুষ্পাঠী প্রভৃতি।
(1) পাঠশালা: হিন্দুদের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠশালার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
- উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্রের বিকাশসাধন, সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা ও ধর্মপরায়ণ করে গড়ে তোলাই ছিল পাঠশালাগুলির শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
- শিক্ষার স্থান: পাঠশালাগুলি গ্রামের বিত্তবান ব্যক্তির বৈঠকখানায় বা পৃথক গৃহে বসত। এ ছাড়া হিন্দু ও জৈন মন্দিরগুলির নিকটবর্তী স্থানে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বেশ কিছু পাঠশালা স্থাপিত হয়েছিল।
- পাঠক্রম ও মাধ্যম: পাঠশালায় সাহিত্য, ব্যাকরণ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি সাধারণ বিষয় ছাড়াও ব্যাবহারিক বিষয় হিসেবে গণিত, বিজ্ঞান, হিসাবশাস্ত্র, জমি জরিপ ইত্যাদি শেখানো হত। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ভারতীয় ভাষাগুলি ব্যবহৃত হওয়ায় পাঠশালার শিক্ষা যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল।
- শিক্ষণ পদ্ধতি: পাঠশালাগুলির শিক্ষণীয় বিষয়গুলির মধ্যে ধর্মশাস্ত্র, ভাষা ও সাহিত্য, প্রাথমিক গণিতের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের আবৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হত। তখনকার দিনে হস্তাক্ষর অনুশীলনের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত।
- শিক্ষক: সাধারণত মন্দিরের পুরোহিত বা অন্য কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি পাঠশালাগুলিতে শিক্ষাদানের কাজ করতেন। ‘সর্দার পড়ো’ পদ্ধতি এসময় বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। সাধারণত পাঁচ বছর থেকে দশ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রদের এখানে শিক্ষা প্রদান করা হত।
- শিক্ষার সুযোগ: একমাত্র নিম্নবর্ণভুক্ত শূদ্র সম্প্রদায় ছাড়া অন্য সকল বর্ণের হিন্দু শিক্ষার্থীরা পাঠশালায় শিক্ষাগ্রহণের অধিকারী ছিল। বৌদ্ধরা অবশ্য সকল বর্ণের হিন্দুদের তাদের পাঠশালায় শিক্ষার সুযোগ দিতেন।
- শিক্ষার ব্যয়: পাঠশালায় ছাত্রদের বেতন ছিল খুবই সামান্য। বেতনে অপারগ ছাত্ররা চাল, ডাল প্রভৃতি শিক্ষকদের প্রদান করত। রাজা, জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা বা ধনী ব্যক্তিদের দানের দ্বারা হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ব্যয়ভার পরিচালিত হত।
(2) টোল ও চতুষ্পাঠী: মধ্যযুগের হিন্দু উচ্চশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলি হল টোল ও চতুষ্পাঠী।
- উদ্দেশ্য: উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে টোলগুলিতে শিক্ষার্থীদের চরিত্রগঠনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। এ ছাড়া ব্রহ্মচর্য পালন, আত্মসংযম ও চিন্তাশক্তির বিকাশের মাধ্যমে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য তৈরি করাও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
- শিক্ষার স্থান: উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলি প্রধানত কোনো ধর্মস্থান বা তীর্থভূমির নিকটবর্তী স্থানে গড়ে উঠেছিল। বাংলার নবদ্বীপ ছিল ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। এ ছাড়া ভারতের কাশী, বারাণসী, এলাহাবাদ, কনৌজ প্রভৃতি স্থানে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে টোল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
- পাঠক্রম ও শিক্ষার মাধ্যম: টোল ও চতুষ্পাঠীগুলিতে ন্যায়শাস্ত্র, বিভিন্ন দর্শন, কাব্য, অলংকার, সংহিতা, তর্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, পুরাণ, সাহিত্য প্রভৃতি পড়ানো হত। শিক্ষার মাধ্যম ছিল পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা ইত্যাদি।
- অবৈতনিক ও আবাসিক: টোল ও চতুষ্পাঠীর শিক্ষা ছিল অবৈতনিক ও আবাসিক। রাজা বা জমিদার বা অন্য কোনো ধনী ব্যক্তির দানের দ্বারা উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলির ব্যয়ভার নির্বাহ হত।
- গুণী পন্ডিত: এই সময় নবদ্বীপের টোল ও চতুষ্পাঠীগুলি পরিপুষ্ট ও বর্ধিত হয়েছিল। সে যুগের গুণী পন্ডিতদের মধ্যে কবি জয়দেব, উমাপতি, রঘুনাথ, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ মনীষীর নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
- শিক্ষাপদ্ধতি: পাঠশালার মতো টোলের শিক্ষাপদ্ধতিও ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং একমুখী ছিল। শিক্ষার্থীরা মমতামত প্রকাশের বিশেষ সুযোগ পেত না। মধ্যযুগে টোল শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বারাণসী বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
- ব্যয় ভার: রাজকীয় অনুদান এবং অভিজাত ও ধার্মিক ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তার দ্বারা এই উচ্চশিক্ষার ব্যয় নির্বাহ হত। বহু উদারনৈতিক সুলতান ও বাদশাহ্ ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। অনেকেই টোল বা চতুষ্পাঠীতে অর্থ সাহায্যও করতেন। যদিও এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার অস্তিত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এযুগের হিন্দুধর্ম ও সমাজব্যবস্থা অনেক বেশি সংকীর্ণ ও রক্ষণশীল হয়ে পড়েছিল, তবুও এ কথা বলা যায়, মধ্যযুগে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর