মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থায় কীভাবে গণসংস্কৃতির প্রসার ঘটে তা আলোচনা করো

মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থায় গণসংস্কৃতির প্রসার
(1) শিক্ষা সমন্বয়: মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থার বড়ো অবদান হল হিন্দু- মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়। আকবর শিক্ষাক্ষেত্রে উভয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি মাদ্রাসায় হিন্দু শাস্ত্রাদি পাঠের ব্যবস্থা করেছিলেন।
(2) গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা: ইসলাম ধর্মের গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা বর্ণভিত্তিক ভারতীয় হিন্দুসমাজের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
(3) বাংলা ভাষার উন্নতি ও প্রসার: মধ্যযুগে সুলতানি আমলে বাংলা ভাষার যথেষ্ট উন্নতি ও প্রসার ঘটে। এইভাবে তাদের নিজস্ব ভাষার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিরও প্রসার ঘটে।
(4) উর্দু ভাষার সৃষ্টি: মধ্যযুগে ভারতে হিন্দি, ফারসি ও আরবি ভাষা মিলে একটি নতুন ভাষা-উর্দু ভাষার সৃষ্টি হয়। ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনসাধারণের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান সহজতর হয়। এইভাবে গণসংস্কৃতি প্রসার লাভ করে।
(5) ধর্মসমন্বয়: মধ্যযুগে বিভিন্ন মহাপুরুষের আবির্ভাব ধর্মসমন্বয়ে সাহায্য করেছিল। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নানক ও কবির। তাঁদের মতের সমন্বয়ের ফলে হিন্দুধর্মে বৈয়ব আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল, যা গণসংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলেছিল।
(6) সাহিত্যের অনুবাদ: এইসময় বহু সাহিত্য অনুবাদ হয়। যেমন— ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময় হিন্দু পণ্ডিতদের নিযুক্ত করা হয়, কয়েকটি বই ফারসি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য। পরাগল খাঁর ছেলে ছুটি খাঁ মহাভারতের ‘অশ্বমেধ পর্ব’ বাংলায় অনুবাদ করেন। ‘ভাগবতের’ অনুবাদক মালাধর বসুকে হুসেন শাহ ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। হুসেন শাহের আনুকূল্যে রামায়ণ ও মহাভারত বাংলায় অনুবাদ হয়েছিল, যা গণসংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
(7) ভাবের আদানপ্রদান: মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় একত্রে বসবাসের ফলে উভয়ের মধ্যে সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ভাবের আদানপ্রদান ঘটে, যা গণসংস্কৃতি প্রসারে সাহায্য করেছিল।
(8) ভন্তি আন্দোলন ও সুফি আন্দোলন: হিন্দুধর্মের রক্ষণশীলতার প্রভাবে ভক্তি আন্দোলনের জন্ম, যার মূল কথা হল একেশ্বরবাদের প্রচার। হিন্দুধর্মের ভক্তি আন্দোলন মুসলিম সমাজকে প্রভাবিত করেছিল। যার ফলশ্রুতি হল সুফি আন্দোলন।
(9) ধর্মসংস্কার আন্দোলন: মধ্যযুগে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের জন্ম হয়। এর ফলে হিন্দু-মুসলিম ব্যবধান অনেকটা কমে যায়, যা গণসংস্কৃতি প্রসারে সাহায্য করেছিল।
(10) সংগীত, চিত্রকলা ও স্থাপত্যশিল্প: হরিদাস, রামদাস, তানসেন প্রমুখ হিন্দু-মুসলিম গুণীজন সংগীতে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। মধ্যযুগের ইসলামিক আদবকায়দা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে আজও দর্শনীয় বস্তু। এগুলি গণসংস্কৃতি প্রসারে সাহায্য করে। এভাবে দেখা যায়, মধ্যযুগে বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যেও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সমন্বয়বাদী ধারার উদ্ভব গণসংস্কৃতির প্রসারে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর