মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার পাঠক্রম এবং শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করো। ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য লেখো

মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার পাঠক্রম
মধ্যযুগীয় ইসলামিক শিক্ষার পাঠক্রমকে দুটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। যথা-
(1) প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা মস্তবের পাঠক্রম: ইসলামীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা মক্তবের পাঠক্রমের মধ্যে লিখন, পঠন, কোরানের আয়াৎ মুখস্থ করা প্রভৃতি বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফারসি ছিল মক্তবগুলির পঠনপাঠনের প্রধান মাধ্যম। এ ছাড়া পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল সুন্দর হস্তাক্ষর, সাহিত্য, ধনুর্বিদ্যা, কাব্যকথা অধ্যয়ন, চিঠিপত্র ও আবেদন লেখা, উক্তি-প্রত্যুক্তি ইত্যাদি।
(2) উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসার পাঠক্রম: আবুল ফজলের লেখা আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে মাদ্রাসার পাঠক্রমকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- ইলাহি-ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক পাঠ। চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, সংগীতশাস্ত্র ইত্যাদি। রিয়াজি-জ্যোতির্বিদ্যা, তাবিকি-র অর্ন্তভুক্ত ছিল ফিকাহ্, হাদিস, ব্যাকরণ, দর্শন, নীতিবাক্য, অলংকার শাস্ত্র, গণিত ইত্যাদি। সম্রাট আকবরের শাসনকালে মাদ্রাসার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ব্যাকরণ, যুক্তিবিজ্ঞান, সাহিত্য, ঈশ্বরতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, নক্ষত্রবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, দর্শনের মতো বিজ্ঞান ও কলাভিত্তিক বিষয়সমূহ।
শিক্ষণ পদ্ধতি
ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষণ পদ্ধতিকে দুটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়-
(1) মন্ত্রাবর শিক্ষণ পদ্ধতি: প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মক্তবগুলিতে প্রধানত মৌখিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হত। এক্ষেত্রে প্রারম্ভিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করানো হত ও তারপর লেখা শেখানো হত।
(2) মাদ্রাসার শিক্ষণ পদ্ধতি: মাদ্রাসায় শিক্ষকগণ মূলত lecture বা বক্তৃতা পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করতেন। ছাত্রদের সার্বিক উন্নতির জন্য প্রত্যেকের জন্য পৃথকভাবে শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সংশ্লেষণী ও আরোহী পদ্ধতি বিশেষভাবে মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত ছিল। ধর্ম, তর্কশাস্ত্র, দর্শন ও রাজনীতি প্রভৃতি পঠনপাঠনে সংশ্লেষণী ও আরোহী পদ্ধতি ব্যবহৃত হত। মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় আত্মপঠন পদ্ধতি বা Self Study প্রচলিত ছিল।
ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
(1) শিক্ষণ পদ্ধতি: ইসলামীয় শিক্ষাব্যবস্থার দুই প্রধান প্রতিষ্ঠান মক্তব ও মাদ্রাসায় মৌখিক পদ্ধতিতেই মূলত শিক্ষাদান করা হত। আলোচনাচক্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ধর্ম, দর্শন, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়গুলি সম্পর্কে শিক্ষাদান করা হত।
(2) শিক্ষক: মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শৃঙ্খলা কঠোরভাবে পালিত হত। প্রয়োজনবোধে শিক্ষকরা শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের দৈহিক শাস্তি প্রদান করতেন। যেমন- চপেটাঘাত, বেত্রাঘাত, কানমোলা ইত্যাদি।
(3) বৈতনিক ও আবাসিক: মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অবৈতনিক ও আবাসিক। জনগণের দানে এবং শাসকশ্রেণির অর্থানুকুল্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ব্যয় নির্বাহ হত।
(4) পরীক্ষা পদ্ধতি: সাধারণভাবে স্পষ্ট কোনো প্রথাগত পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা না থাকলেও কোনো বিশেষ বিষয়ে শিক্ষার্থীর দক্ষতা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকের প্রশংসাপত্রের সাহায্যে নির্ণীত হত। ক্রমিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা ছিল। মাঝে মাঝে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হত। এগুলি থেকেও শিক্ষার্থীর পান্ডিত্য সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত।
(5) শিক্ষার মাধ্যাম : ইসলামীয় শিক্ষাব্যবস্থায় মক্তব ও মাদ্রাসায় শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হিসেবে আরবি ও ফারসির প্রচলন ছিল। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাতৃভাষাও ছিল শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। মুঘল সম্রাট আকবর হিন্দি শেখার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। আলোচ্য সময়ে আরবি, ফারসি, হিন্দি প্রভৃতি ভাষার সংমিশ্রণে উর্দু ভাষার উদ্ভব ঘটে।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর