ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে শ্রীরামপুর ত্রয়ীর কার্যাবলি/অবদান বর্ণনা করো

শ্রীরামপুরের দিনেমার কুঠিকে কেন্দ্র করে উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম ওয়ার্ড এবং জসুয়া মার্শম্যান এই তিনজন মিশনারি একত্রে ধর্ম ও শিক্ষা প্রচারে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই তিনজনই শ্রীরামপুর ত্রয়ী নামে পরিচিত। কেরি ছিলেন ধর্মপ্রচারক, ওয়ার্ড ছিলেন দক্ষ মুদ্রণশিল্পী এবং ম্যার্শম্যান ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। শিক্ষা প্রসারের এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটে এই তিন শিক্ষানবিশ-এর সমবেত প্রচেষ্টায়। কেরির সহায়তায় 1827 খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্রীরামপুর মিশন একটি স্বতন্ত্র মিশনারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এদের উদ্যোগে শ্রীরামপুরে একটি দেশীয় বিদ্যালয়, যশোরে 4টি, দিনাজপুরে 1টি এবং কাটোয়ায় 1টি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
শ্রীরামপুর ত্রয়ীর বিভিন্ন কার্যাবলি
(1) শ্রীরামপুর ত্রয়ীর মুখ্য উদ্দেশ্য পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ হলেও দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে তারা বাতিল করেনি। পাশাপাশি মাতৃভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ব্যাকরণ, গণিত ও প্রাথমিক গণনা, প্রাথমিক ভূগোল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস ও নীতিশিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
(2) ভারতে মুদ্রণ শিল্পের প্রবর্তন শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগেই সম্পন্ন হয়েছিল। কেরি ও তাঁর সহযোগীরা শিক্ষাবিস্তার করতে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকের অভাব বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সেইসময় পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন মূলত বাইবেল ছেপে বিতরণের উদ্দেশ্যে।
(3) এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য বই নিউ টেস্টামেন্ট ও ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর আংশিক অনুবাদ, কেরির লেখা ‘গসপেল অফ মেমু’-র অনুবাদ হয়। মিশনারিরা সংস্কৃত শিখে অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন। যেমন-শুদ্ধবোধ ব্যাকরণ, কেরির সংস্কৃত ব্যাকরণ, কেরি ও মার্শম্যান সম্পাদিত বাল্মীকি ব্যাকরণ, রামায়ণ ইত্যাদি। এ ছাড়াও রাজীবলোচন উপাধ্যায়ের ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রহস্য চরিতম’ এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘রাজাবলি’, ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ ইত্যাদি।
(4) মিশনের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যে কমিটি গঠন হয়েছিল, সেখানে ছিলেন, উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম ওয়ার্ড ও জসুয়া মার্শম্যান। মিশনের শিক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে Andrew Bell মনিটর প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষণের জন্য 1818 সালে মিশন নর্মাল স্কুলও স্থাপন করেন।
স্ত্রীশিক্ষা
ইংরেজ শাসনকালে মেয়েদের শিক্ষার অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সাধারণ ঘরের মেয়েদের শিক্ষার অনুকূল অবস্থা ছিল না। মিশনের উদ্যোগে মেয়েরা শিক্ষায় আলোকিত হতে শুরু করে। 1807 খ্রিস্টাব্দে তারা একটি ছেলেদের বিদ্যালয়ে একটি মেয়েকে ভরতি করে এবং শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এটিকে বলা যেতে পারে এদেশের মেয়েদের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষার প্রথম সোপান। পরবর্তীকালে 1810 সালে মেয়েদের জন্য বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই সকল দৃষ্টান্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতার কয়েকটি মহিলা সংগঠন এগিয়ে আসে এবং কলকাতায় স্ত্রীশিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
1821 সালে উইলিয়াম ওয়ার্ডের প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুরের আশেপাশের গ্রামে বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। 1838 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মিশন প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় 28টি। মিশন বাংলার পাশাপাশি বাংলার বাইরেও এলাহাবাদ ও বেনারসেও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল। উচ্চশিক্ষার বিস্তারের জন্য 1818 সালে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পত্রপত্রিকার দিক থেকে মিশনের অবদান অবিস্মরণীয়। যেমন-1818 খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে ‘দিক্ দর্শন’ পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়াও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সমাচার দর্পন’ এবং সাময়িক পত্রিকা ‘মান্থলি সারকুলার লেটার’ প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর