ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো
ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ 

(1) শিক্ষার লক্ষ্য: ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার লক্ষ্যগুলি হল- আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধি, দেহ ও মনের বিকাশ, সামাজিক বিকাশ, আত্মার মুক্তি, ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ সাধন করা।

(2) পাঠক্রম: বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রমকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা এবং অপরাবিদ্যা বা বাস্তব জীবন উপযোগী বিদ্যা।

(3) বিদ্যারম্ভ এ উপনয়ন: প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় পাঁচ বছর বয়সে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হত। এই অনুষ্ঠানটি বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- ‘বিদ্যারম্ভ’, ‘চৌল কর্ম’, ‘অক্ষর স্বীকরণ’ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে বৈদিক শিক্ষা জটিল হয়ে পড়ায় গুরুকুল আবশ্যিক হয়ে পড়ল। গুরুগৃহে শিক্ষা একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হত যার নাম উপনয়ন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের যথাক্রমে ৪, 11 ও 12 বছর বয়সে শিক্ষাগ্রহণ শুরু হত। শূদ্রদের উপনয়ন অনুষ্ঠান হত না।

(4) শিক্ষালয়: বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য যুগে শিক্ষালয় বলতে বোঝায় গুরুগৃহ। উপনয়নের পর তরুণ বিদ্যার্থী বা ব্রহ্মচারীকে গুরুগৃহে থাকতে হত। শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার আগে গুরুগৃহ ত্যাগ করা ধর্মবিরুদ্ধ বলে মনে করা হত। এখানে শিক্ষার্থীকে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হত। নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত কুটিরগুলিই হল বর্তমান শিক্ষালয়ের আদি রূপ। একজন গুরুকে কেন্দ্র করে এক-একটি গুরুকুল গড়ে উঠত। 

(5) ব্রহ্মচর্য : চারটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত ছিল চতুরাশ্রম। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস- এর মধ্যে ব্রহ্মচর্য হল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সময়কাল। উপনয়নের পর তরুণ ব্রহ্মচারীকে গুরুগৃহে থাকতে হত। সমগ্র শিক্ষাকাল গুরুগৃহে থেকে শিক্ষার্থীকে কঠোর নিয়মকানুন পালন করতে হত।

(6) বাৎসরিক অধ্যয়নকাল: প্রতি বছর চার মাস থেকে সাড়ে পাঁচ বা ছয় মাস পর্যন্ত শিক্ষাকার্য চলত। শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন উপকর্মণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পাঠ শুরু হত। উৎসর্জন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পৌষ বা মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম দিন বছরের পাঠ শেষ হত।

(7) শিক্ষাকাল: বেদ শিক্ষার জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হত। বেদের শিক্ষাকাল ছিল 12 বছর।

(৪) শিক্ষণ পদ্ধতি: বৈদিক যুগে শিক্ষণ পদ্ধতি ছিল মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও মৌখিক। শুনে শুনে পাঠ মুখস্থ করতে হত। তবে শিক্ষণ পদ্ধতির কতকগুলি পর্যায় ছিল। সেগুলি হল- উপক্রম, শ্রবণ, আবৃত্তি, অর্থবাদ, মনন, নিদিধ্যাসন। এই পর্যায়গুলির মধ্যে প্রশ্ন ও বিচারপর্বও চলত। যুক্তি সহকারে আলোচনা করে জ্ঞানের ভিত আরও সুদৃঢ় হত। শিক্ষণ পদ্ধতিতে স্মৃতি ও মেধার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল।

(9) সমাবর্তন : সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শিক্ষার সমাপ্তি ঘোষিত হত। এই অনুষ্ঠানে গুরু শিষ্যকে ‘স্নাতক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তিন ধরনের স্নাতক ছিল। যথা, বিদ্যাস্নাতক, ব্রতস্নাতক, বিদ্যাব্রত স্নাতক। গুরু শিষ্যকে জীবনে চলার জন্য কতকগুলি উপদেশ দিতেন যা আজও শ্রেষ্ঠ উপদেশ বলে বিবেচিত।

(10) গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক: বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। গুরু শিষ্যের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেন। গুরু শিষ্যের রোগশয্যায় মায়ের মতো সেবা করতেন। শিষ্যও গুরুর অসুস্থতায় পুত্রের মতো সেবা করত। বিনা পারিশ্রমিকে গুরু শিক্ষা দিতেন। গুরুর সান্নিধ্যে থেকে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব, উন্নত চরিত্র গড়ে উঠত।

(11) শিক্ষার ব্যয়ভার : শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক। দরিদ্র্য শিক্ষার্থীও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হত না। শিক্ষার্থীরা ভিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের ব্যয় নির্বাহ করত। রাজা ও অভিজাত সম্প্রদায় এবং সাধারণ ব্যক্তিগণ পরোক্ষভাবে গুরুদের অর্থ সাহায্য করতেন। তবে শিক্ষার শেষে শিষ্য তার সাধ্যমতো গুরুদক্ষিণা দিত। ১ বিমান বনস

(12) শৃঙ্খলা: শিক্ষার্থীদের কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলতে হত। কোনো অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতে হত। শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার শাস্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। সরু দড়ি বা বেত দিয়ে প্রহার করা, অপরাধীকে ভীতি প্রদর্শন, উপবাস, ঠান্ডা জলে স্নান অথবা আচার্যের দৃষ্টির বাইরে নির্বাসন দিয়ে শাস্তি দেওয়া হত।

(13) নারীশিক্ষা: নারীদের শিক্ষার অধিকার ছিল। এই সময়ের বিদুষী নারীরা হলেন অপালা, লোপামুদ্রা প্রমুখ।

(14) পরীক্ষা: বিশেষ কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তবে শিষ্যদের যোগ্যতা যাচাই করার জন্য বিতর্কসভা, আলোচনা সভার আয়োজন করা হত। এই সভা অনুষ্ঠিত হত তপোবন, রাজসভা বা যজ্ঞস্থলে। যোগ্য বিচারকগণ প্রশ্নোত্তরের বা বিতর্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা বিচার করতেন।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment