বৈদিক পরবর্তী যুগ বা উপনিষদের যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

বৈদিক পরবর্তী যুগ হল খ্রিস্টপূর্ব 1100 – খ্রিস্টপূর্ব 500 বছর পর্যন্ত। অর্থাৎ, ঋগ্বেদের সমাপ্তিকালীন সময় থেকে বৌদ্ধ ও জৈন যুগের সূচনাকাল পর্যন্ত সময়। বৈদিক যুগের কঠোর আত্মসংযম এবং আত্মত্যাগ এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বলাভ করেছিল।
পরবর্তী বৈদিক যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ
(1) শিক্ষার লক্ষ্য: সাধারণ লক্ষ্য ছিল মোক্ষ (মুক্তি) লাভ। যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হত অর্থাৎ শিক্ষার লক্ষ্য ছিল যাগযজ্ঞকেন্দ্রিক। মূল মন্ত্র হল- সত্যং জ্ঞানমনস্তং ব্রহ্ম অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে পরম জ্ঞানের উপলব্ধি। এ ছাড়া অন্যান্য লক্ষ্যগুলি বৈদিক যুগের লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
(2) শিক্ষার উদ্দেশ্য: পরমব্রহ্মের ধারণা লাভ করাই ছিল এই যুগের শিক্ষা হল অন্তজ যোগসাধনা ও চিন্তনের শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া, আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করা, সত্য, ন্যায়, সততার থেকে বিচ্যুত না হওয়া, মানবতা ধর্মকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ, চরিত্রগঠন, বিভিন্ন ধরনের অহিতকর প্রক্ষোভ ত্যাগ করা, যথাযথ মানসিক বিকাশ ইত্যাদি।
(3) পাঠক্রম: এই যুগের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল- ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদের চর্চা, কাজ, অঙ্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, হাতের জ্যামিতি, ব্যাবহারিক জ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞান। এ ছাড়া বস্তুর আকার, স্থান নির্বাচন, সময় নির্ধারণ, অনুষ্ঠানের স্থান নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয় শেখানো হত।
(4) শিক্ষণ পদ্ধতি: এই সময় তিনটি শিক্ষণ পদ্ধতি অনুসৃত হত- শ্রবণ (শিখন), মনন (যোগসাধনা), নিদিধ্যাসন (উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা)। গুরু শিষ্যদের মৌখিক শিক্ষা ও নির্দেশনা দান করতেন এবং শিষ্যরা যোগসাধনার মধ্য দিয়ে অধ্যয়ন করত। এসময় প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। গুরু শিষ্যদের যাবতীয় প্রশ্ন শুনতেন এবং পরমব্রহ্ম সংক্রান্ত বক্তৃতা দিতেন
পাঠদান পদ্ধতির কয়েকটি স্তরভেদ ছিল। যথা- উপক্রম (প্রস্তুতি), শ্রবণ, আবৃত্তি, ফল, উপপত্তি। উপক্রম হল শিষ্যের গুরুর কাছে জানার আগ্রহ, শ্রবণ হল গুরু যা বলেন তা মনোযোগ দিয়ে শোনা, আবৃত্তি হল গুরুর কাছ থেকে তা অভ্যাস করা, ফল হল যা শেখানো হল তার অর্থ বোঝা, উপপত্তি হল আলোচনা করে যুক্তির সাহায্যে জ্ঞানের ভিত্তি জয় করা। গল্পের মাধ্যমে শিক্ষাদানে গুরুত্ব দেওয়া হত।
(5) শিক্ষাকাল: বেদ শিক্ষার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হত। 12 বছর ছিল পাঠগ্রহণের শিক্ষাকাল। তবে ব্রহ্মচারীরা আমৃত্যু গুরুগৃহে বাস করে বেদ পাঠ করতে পারত।
(6) শিক্ষায় প্রাবশ (উপনয়ন): ছেলেদের শিক্ষার আগে উপনয়ন অনুষ্ঠান হত। উপনয়নের অর্থ হল গুরুর নিকটে আসা, অন্য অর্থে শিষ্য গুরুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেতেন। তিনদিন ধরে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হত। শিক্ষার্থী (শিষ্য) অগ্নিকাষ্ঠ হাতে নিয়ে গুরুর কাছে গিয়ে তাকে ব্রহ্মচারীরূপে গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করত। গুরু তার জাত, শ্রেণি সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন এবং সন্তুষ্ট হলে শিষ্যরূপে তাকে গ্রহণ করে আশীর্বাদপুষ্ট হাত শিষ্যের মাথায় রাখতেন।
(7) শিল্ডালয় (গুরুকুল): উপনিষদের যুগেও শিষ্যরা গুরুকুলে শিক্ষা শুরু করত। সে যুগে শিক্ষালয় বলতে গুরুকুলকেই বলা হত। গুরুগৃহে শিষ্যরা বিনা পারিশ্রমিকে পড়াশোনা করত। শিষ্যরা গুরুদের যেমন সেবা করত, ঠিক তেমনই গুরুরাও শিষ্যদের পুত্রের মতোই পালন করতেন।
(8) গুরু-শিষ্য সম্পর্ক:
- গরুর দায়িত্ব: শিষ্য তার গুরুকে সেবা করত। বারো বছর পর শিষ্য আশ্রমের দায়িত্বপালন করত। গুরু তাঁর শিষ্যকে নিজের পুত্রের মতো পালন করতেন এবং তার জন্য সমস্ত সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করতেন। গুরু তার কোনো জ্ঞান শিষ্যের কাছে গোপন করতেন না। খুঁটিনাটিভাবে পরীক্ষা করে শিষ্যকে পরমজ্ঞান দান করতেন।
- শিষ্যের দায়িত্ব: শিষ্যের কর্তব্য ছিল জ্ঞানলাভের জন্য গুরুর চরণের সংস্পর্শে বসা, গুরুর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান শোনা। শিষ্যের করণীয় কর্তব্যগুলি হল তিন ধরনের শিক্ষা- • ব্যাবহারিক শিক্ষা, মানসিক শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা।
(9) সমাবর্তন অনুষ্ঠাল : এটি হল শিক্ষার শেষ অনুষ্ঠান। শিক্ষা শেষে শিষ্য যখন গুরুকুল ছেড়ে পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করে, তখন গুরু তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের নির্দেশ দিতেন। এর জন্য যে উৎসব হত, তাকে বলে সমাবর্তন উৎসব। এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য শিষ্যকে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান করতে হত। আচার্যের অনুমতি নিয়ে শিষ্য আনুষ্ঠানিক স্নান সমাপ্ত করে স্নাতক হিসেবে পরিগণিত হতেন। ব্রহ্মচর্য আশ্রমের বেশ পরিত্যাগ করে নতুন বেশভূষায় সজ্জিত হতেন। স্নাতক তিন রকমের হত- বিদ্যাস্নাতক, ব্রতস্নাতক এবং বিদ্যাব্রত স্নাতক।
(10) বিভিন্ন জাতের শিক্ষা : সেইসময় শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব ছিল। তারা বিশেষ করে বৈদিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করত। কিছু ক্ষত্রিয়দেরও আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছিল, তাই ক্ষত্রিয়দের মধ্যেও ঋষি পাওয়া যায় এ ছাড়া দার্শনিকেরও নাম পাওয়া যায়। এই যুগে বৈশ্য ও শূদ্রদের শিক্ষা নিয়ে কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তবে বৈশ্যরা কৃষি, শিল্প, ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকত এবং শূদ্রদের কাজ ছিল উচ্চবর্ণের মানুষদের সেবা করা।
(11) নারীশিক্ষা: পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীরা বৈদিক যুগের মতো সামাজিক ও শিক্ষামূলক সুযোগ ভোগ করত না। তারা যেমন স্বাধীনভাবে সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত না তেমনই পারিবারিক সম্পত্তির অধিকারী হতে পারত না। কিন্তু তাদের ধর্মীয় স্থান অনেক নিরাপদ ছিল। সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্বামীর সঙ্গে অংশগ্রহণ করত। তবে উপনিষদের যুগে নারীরা নাচ, গান, চারুকলায় প্রশিক্ষণ নিত।
(12) বৃত্তিশিল্ডা: পরবর্তী বৈদিক যুগ বা উপনিষদের যুগে জীবনের ব্যাবহারিক প্রয়োজনে বৃত্তি নিয়ে সমাজে জাতিভেদ প্রথা গড়ে উঠেছিল। তবে জাতিভেদ প্রথায় কঠোরতা ছিল না। সামাজিক ব্যবস্থা যাতে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সেজন্য বিভিন্ন বর্ণের লোককে বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দেওয়া হত।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর