প্রাচীন ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করো

প্রাচীন ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করো

অথবা, বেদের কয়টি অংশ ও কী কী? বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা করো

প্রাচীন ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করো
প্রাচীন ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করো

বেদের চারটি অংশ রয়েছে। যথা- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ।

বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। শিক্ষাকে সত্য উপলব্ধির উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হত। আর্য সভ্যতার যুগে প্রবর্তিত এবং আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 1500 বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব 500 বছর পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের বেদনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈদিক শিক্ষা বলা হয়। এই শিক্ষা শ্রবণনির্ভর হওয়ায় বেদের অপর নাম শ্রুতি। বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি হল- 

(1) শিক্ষার লক্ষ্য: বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার লক্ষ্য ছিল মোক্ষলাভ, পূর্ণতালাভ তথা আত্মোপলব্ধি। এ ছাড়া ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন এবং ব্যাবহারিক জ্ঞান লাভ করা ছিল এই শিক্ষার চরম লক্ষ্য। প্রাচীন ঋষিগণ মনে করতেন বিজ্ঞান যাকে জড়জগৎ বা বস্তুজগৎ বলে, তার বাইরে একটি জগৎ আছে যার নাম আধ্যাত্মিক জগৎ। এই জগতের অধীশ্বর হলেন পরমসত্য ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। মানবজীবনে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হল ওই পরমসত্য ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা। এর মাধ্যমে ব্যক্তির মোক্ষলাভ ঘটবে।

(2)  শিক্ষার সূচনা: এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর প্রথম অক্ষর পরিচয় হত গৃহে ‘বিদ্যারম্ভ’ বা ‘অক্ষর স্বীকরণ’ নামক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এরপর গুরুগৃহে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হত। বিভিন্ন বর্ণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা বিভিন্ন সময়ে হত। ব্রাহ্মণদের গুরুগৃহে শিক্ষা শুরু হত আট (৪) বছর বয়সে, ক্ষত্রিয়দের এগারো (11) বছর বয়সে এবং বৈশ্যদের বারো (12) বছর বয়সে। শূদ্রদের শিক্ষার কোনো অধিকার ছিল না।

(3) অনুষ্ঠান ভিত্তিক : বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ছিল অনুষ্ঠান ভিত্তিক। ‘উপনয়ন’ নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গুরুগৃহে শিক্ষার্থীর শিক্ষার সূচনা হত। আর ‘সমাবর্তন’ নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিক্ষার সমাপ্তি ঘটত, প্রত্যেক শ্রেণির শিক্ষার সময়কাল ছিল 12 বছর।

(4) ধর্মীয় অনুজ্ঞা: উপনয়নের পর ব্রহ্মচারী শিক্ষার্থীকে কয়েকটি অবশ্য পালনীয় অনুষ্ঠান করতে হবে। যেমন- পরিদান, গামপৃচ্ছ, আদিত্য দর্শন, অগ্নি প্রদক্ষিণ।

(5) শিক্ষাপদ্ধতি: বৈদিক শিক্ষা মূলত মৌখিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হত। গুরুর মুখে শুনে শুনে শিষ্যরা মনে রাখত এবং আলোচনার মাধ্যমে বুঝে বুঝে পাঠগ্রহণ করত। এইভাবে শেখার পর সেগুলি নিয়ে তারা চিন্তা করত। শেষে চিন্তালব্ধ সিদ্ধান্তগুলিকে তারা ধ্যানের মাধ্যমে উপলব্ধি করার প্রয়াসী হত অর্থাৎ শিখনের স্তরগুলি হল- ‘শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন’।

(6) ধর্মভিত্তিক শিক্ষা: বৈদিক ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা মূলত ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ধর্মশিক্ষার মধ্য দিয়েই শিক্ষার্থীরা ন্যায়-অন্যায় সামাজিক রীতিনীতি প্রভৃতি বিষয় আয়ত্ত করত।

(7) আশ্রমকেন্দ্রিক: বৈদিক যুগে গুরুগৃহকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে এক-একটি আবাসিক-আশ্রমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। উপনয়নের পর বিদ্যালয়ের জন্য শিষ্যরা গুরুগৃহে সমাবেত হত এবং গুরুগৃহে থেকে পড়াশোনা করত। তাই শিষ্যদের বলা হত গুরুকুলবাসী বা অন্তেবাসী।

(8) পাঠক্রম: বৈদিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা বেদ, ষড়বেদাঙ্গ প্রভৃতি চর্চা করত। বেদের পাশাপাশি তারা ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ছন্দ, তর্ক প্রভৃতি বিষয়েও শিক্ষালাভ করত। পরবর্তীকালে বর্ণাশ্রম চালু হওয়ার পর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যদের বৃত্তি অনুযায়ী পাঠক্রমের বিভিন্নতা তৈরি করা হয়। ব্রাহ্মণদের জন্য ছিল- বেদ, বেদাঙ্গ, আরণ্যক, উপনিষদ প্রভৃতি। ক্ষত্রিয়দের- শিক্ষার পাঠক্রমে যুদ্ধবিদ্যা, দণ্ডনীতি, ধর্মশাস্ত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। বৈশ্যদের- পশুপালন, কৃষিকাজ, বাণিজ্য, ধাতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে হত।

(9) গুরুশিষ্য সম্পর্ক: প্রাচীন ভারতে গুরুশিষ্যের সম্পর্ক ছিল গভীর। অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা এই সম্পর্কের মধুরতাকে বাড়িয়ে তুলেছিল।

  • এই যুগে গুরুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা হওয়ায় গুরুকে ছাড়া পড়াশোনা কেউ করত না।
  • শিষ্য গুরুর আশ্রমে খাওয়াদাওয়া করত, সমস্ত রকম কাজকর্ম করত।
  • শিষ্যরা তাদের গুরুকে পিতার মতো শ্রদ্ধা করত। উপনয়নের পর থেকে শিষ্যরা নিজেদেরকে গুরুর কাছে সঁপে দিত।
  • গুরু শিষ্যদের মুখে মুখে বেদ শিক্ষা দান করতেন। শিষ্যরা তা পরম্পরায় পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রচার করত।

(10) নিয়মশৃঙ্খলা: গুরুর গৃহে নিয়মশৃঙ্খলা ছিল কঠোর প্রকৃতির, যা শিষ্যদের চরিত্রের দৃঢ়তা গঠনে সহায়তা করত।

(11) পাঠদান পদ্ধতি: বৈদিক যুগে ঋষি শিক্ষকদের অন্যতম পাঠদান পদ্ধতি ছিল আবৃত্তি। শ্লোকের প্রত্যেকটি পদ ছন্দসহকারে শেখানো হত। শিষ্যরা আবৃত্তির মাধ্যমে তা আয়ত্ত করত।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment