প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার উপাদানগুলি কী কী? সেগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার উপাদানগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেগুলি হল- জাতিগত উপাদান, ভৌগোলিক উপাদান, সামাজিক উপাদান, ধর্মীয় উপাদান।
(1) জাতিগত উপাদান : অতি প্রাচীন ভারতবর্ষে যেসব মানুষ বাস করত, তারা কোনো জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির আগমন হয় এবং প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতির মেলবন্ধন হয়। ইতিহাসবিদ ও নৃতত্ত্ববিদদের মত অনুযায়ী, আর্য, দ্রাবিড়, সিজি আর ও ম্যাঙ্গোলিয়ান এই চার ধরনের জাতির মানুষ ভারতে এসে বসবাস করে। তাদের সংস্কৃতিগত মেলবন্ধনের ফলে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তা-ই হিন্দু নামে পরিচিত হয়। আর্য যুগে বৈদিক ঋষিগণ মন্ত্ররচনা, আত্মত্যাগ, যুদ্ধে পারদর্শিতা, ফসল ফলানো ইত্যাদি গুণের অধিকারী ছিলেন। দ্রাবিড়রা সংগীত, সূক্ষ্মকলায় পারদর্শী ছিল। এইভাবে আর্য ও অনার্যদের সংস্কৃতি ও আদর্শের সমন্বয়ে হিন্দু সভ্যতা জন্ম নেয়। সুতরাং প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার আধ্যাত্মিক দিক যেমন আর্যদের কাছ থেকে পাওয়া ঠিক তেমনই বৃত্তিমূলক দিকগুলি দ্রাবিড় জাতির কাছ থেকে পাওয়া।
(2) ভৌগোলিক উপাদান: ভারতের প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতা, দেশের জলবায়ু, উর্বর মাটি ইত্যাদি বিভিন্ন ভৌগোলিক উপাদান আর্য, অনার্যদের বসবাসের উপযোগী ছিল। কারণ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম সহজ ও সরল হয়ে যায়। সৌন্দর্যময় প্রকৃতি প্রাচীন আর্য ঋষিদের আধ্যাত্মিক চিন্তার জন্য সহজ ক্ষেত্রে পরিণত হল। তাঁদের আধ্যাত্মিক ভাবনা, নিত্যনতুন চিন্তাভাবনা থেকে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
(3) সামাজিক উপাদান: সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বেদ ঋগ্বেদের যুগে জাতিগত প্রথার উদ্ভব হয়নি তবে যারা আধ্যাত্মিকতা, বেদ ও মন্ত্র পাঠ ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিল, তারা পুরোহিত। যারা যুদ্ধবিগ্রহ করতে পারত তারা ক্ষত্রিয়, যারা চাষবাস করত তারা বৈশ্য- এইভাবে বিভিন্ন জ্ঞানের দ্বারা নিজেদের ভিত্তি দৃঢ় করতে শুরু করে। সমাজের জটিলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন হিন্দুরা শ্রমের বিভাজনের মাধ্যমে নিজস্ব গুণ, ক্ষমতা অনুযায়ী কাজে অংশগ্রহণ করত এবং বংশপরম্পরায় তা মেনে চলত; এইভাবে পরবর্তী সময়ে জাতিভেদ প্রথার সৃষ্টি হয়। সুতরাং বিভিন্ন জাতির জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। তারই প্রভাবে শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, পদ্ধতি, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হতে শুরু করে।
(4) ধর্মীয় উপাদান: ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের তুলনায় ধর্মীয় উপাদান অনেক বেশি পরিমাণে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই ভারতীয় শিক্ষায় ধর্মের প্রভাব রয়েছে। প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার মানুষজনের কাছে ধর্ম হল এমন এক নীতি, যা মানুষের ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনের মানকে সঠিক নির্দেশ দেয়। অর্থাৎ ধর্ম হল আদর্শ, অনুশীলন, নৈতিকতাবোধ, কর্তব্যবোধ ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের সমন্বয়।
এই ধর্মীয় উপাদান জীবনযাপন ব্যবস্থা, ব্যাবহারিক অনুশীলন, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এমনকি শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে। এই কারণে ধর্ম প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার সামাজিক জীবন ও সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করত। ধর্ম তৎকালীন সমাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করত। সুতরাং তৎকালীন ভারতীয় সমাজ দেশকে আধ্যাত্মিকতাবাদ ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে নির্ধারণ করত অর্থাৎ দেশ ছিল সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতি ছিল দেশ। তাই প্রাচীনকাল থেকেই ভারত বিভিন্ন জাতির এক সুন্দর স্থান রূপে গড়ে ওঠে।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর