প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী, সংক্ষেপে আলোচনা করো

প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী, সংক্ষেপে আলোচনা করো

প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী, সংক্ষেপে আলোচনা করো
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী, সংক্ষেপে আলোচনা করো

মানবসভ্যতা শিক্ষাব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস অতি প্রাচীন। পাঞ্জাবের হরপ্পা, সিধু প্রদেশে মহেন-জো-দারো, বেলুচিস্তানের নীল ও সিন্ধু উপত্যকায় প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। এর পরবর্তীতে আর্যসভ্যতা, যা আর্য ও অনার্যদের সমন্বয়নের ফলে জন্মলাভ করে, এটি হিন্দু বা ভারতীয় সভ্যতা নামে পরিচিত। 

তাই ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার যুগকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়- সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতার যুগ, আর্যসভ্যতার যুগ, তপোবনের বৈদিক যুগ, যুগেই। ব্রাহ্মণ্য যুগ, বৌদ্ধ যুগ। এই প্রতিটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল।

(1) সিন্ধু সভ্যতার যুগ

ঋগ্বেদ থেকে জানা যায় আর্যরা সপ্তসিধু পেরিয়ে যে উন্নত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার সম্মুখীন হয়, সেটি হল সিধু সভ্যতা। এই উন্নত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় সীলমোহরের লিপি পাওয়া গেছে যার পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি। তবে এ কথা ঠিক যারা লিপির ব্যবহার জানত, তাদের নিশ্চয়ই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। যা সম্বন্ধে এখনও আমাদের হাতে কোনো সঠিক তথ্য নেই। তাই আর্যসভ্যতাকে অনেক ক্ষেত্রে প্রাচীন সভ্যতা বলা হলেও সিন্ধুসভ্যতা ও আর্য সভ্যতার মাধ্যমেই ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।

(2) আর্যসভ্যতার যুগ

আনুমানিক 1500 খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যদের ভারতে আগমন ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব 1500 থেকে 1000 অব্দ পর্যন্ত ঋক্ বৈদিক যুগ এবং 1100 থেকে 500 অব্দ ছিল পরবর্তী বৈদিক যুগ। ঋগ্বেদের যুগের প্রধান ঐতিহাসিক উপাদান হল ঋগ্বেদের বিভিন্ন স্তোত্র। আর্যরা এদেশে এসে প্রথমে সপ্তসিধু অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। সপ্তসিন্ধু বলতে ইরান, আফগানিস্তানের কিছুটা অংশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব অঞ্চলকে বোঝানো হত। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে গঙ্গা, যমুনা, সরযূ নদীর অববাহিকা অঞ্চলে এই সভ্যতা প্রসারিত হয়। আর্যসভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। ঋগ্বেদের যুগে আর্যরা ছোটো ছোটো পরিবারে গ্রামে বাস করত। সমাজব্যবস্থা ছিল পিতৃতান্ত্রিক এবং প্রাচীন আর্যসমাজ ছিল গণতান্ত্রিক।

(3) তপোবনের সভ্যতা

আর্যসভ্যতা ছিল তপোবনের সভ্যতা। সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে আর্যরা যখন তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তখন অঞ্চলটি ছিল অত্যন্ত উর্বর। অল্প পরিশ্রমে প্রচুর খাদ্যশস্য পাওয়া যেত। জীবিকা অর্জনের জন্য তাদের কষ্ট করতে হত না। অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় পরিবেশে সরল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাত্রা আর্যদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছিল। তখন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন অধ্যাবসায়ের ফসল হিসেবে বিভিন্ন দর্শন, কাব্য ও সাহিত্য গড়ে ওঠে।

(4) বৈদিক সভ্যতার যুগ

আর্যরা প্রকৃতির শক্তিকে বিভিন্ন দেবদেবীরূপে কল্পনা করতেন। বৈদিক শিক্ষা বা হিন্দু শিক্ষার মূল কথাই হল আর্য ঋষিদের আধ্যাত্মিক চিন্তা। তাঁরা অনুভব করতেন ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। পরমসত্তার সঙ্গে মিলে যাওয়াই হল প্রাচীন ভারতীয় দর্শন। আর্যরা বিভিন্ন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে স্তব-স্তুতি পাঠ করে অগ্নিতে আহুতি প্রদান করতেন। আর্যদের উপাসনা প্রথম যুগে সহজ হলেও ক্রমশ বিভিন্ন নিয়মকানুন সৃষ্টি হওয়ায় এবং সকলের পক্ষে নিয়মকানুন মেনে চলা কঠিন হয়ে পড়ায় পুরোহিত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। পুরোহিতরাই হলেন ধর্মের ধারক, বাহক ও রক্ষক। আর্যদের ঋষি পরিবারের মানুষজন পুরোহিত হতে পারতেন। ঋষি পরিবারেই বৈদিক শিক্ষার সূচনা হয়। এই শিক্ষা কাঠামোতে আর্য ও অনার্য উভয়েরই প্রভাব ছিল।  বৈদিক সভ্যতার যে বৈশিষ্ট্যগুলি রয়েছে, সেগুলি হল-

  • (1) জাতিভেদের সূচনা: আর্যসমাজে দুধরনের আর্য ছিল- গৌরবর্ণ আর্য, কৃষ্ণবর্ণ আর্য। তবে ক্রমাগত সমাজে জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুণ ও কাজ অনুযায়ী শ্রেণিভেদ প্রথা গড়ে ওঠে। যারা যাগযজ্ঞ, পড়াশোনা নিয়ে থাকতেন, তাঁরা হলেন ব্রাহ্মণ; যারা রণনিপুণ, বীর, রাষ্ট্রনীতিতে দক্ষ তাঁরা হলেন ক্ষত্রিয়; কৃষিকাজ, ব্যবসাবাণিজ্য, পশুপালনে দক্ষ সম্প্রদায় হল বৈশ্য এরা অনার্য জাতির মানুষ শস্ত্র রন্দ্রে প্ররিচিত ছিল।
  • (2) চতুরাশ্রম: আর্যসমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণের জন্য ছিল চতুরাশ্রম। উপনয়নের পর ব্রহ্মচর্য পালন করে গুরুগৃহে ছাত্ররূপে থাকতে হত। ছাত্রজীবন শেষ করে প্রবেশ করত গার্হস্থ্য জীবনে। এরপর ছিল বানপ্রস্থ এবং চতুর্থ আশ্রম হচ্ছে সন্ন্যাস। কেউ কেউ আবার গার্হস্থ্য ধর্ম পালন না করে তপস্যা ও সত্যানুসন্ধানের মাধ্যমে জীবন কাটাতেন।
  • (3) বৈদিক শিক্ষা: বেদ ছিল বৈদিক শিক্ষার ভিত্তি। বেদের প্রকৃত অর্থ হল জ্ঞান। বেদ হল পদ্যের সমন্বয়, তবে কিছু অংশ গদ্য আকারেও লেখা রয়েছে। আর্য সংস্কৃতির জ্ঞান বেদের মধ্যে রয়েছে। বেদ ছিল অলিখিত। গুরুর কাছে শিষ্যরা তা শুনে মুখস্থ করে নিত, তাই বেদের অপর নাম শ্রুতি। বেদের চারটি ভাগ রয়েছে- ঋক্, সাম, যজু, অথর্ব। প্রত্যেক বেদ আবার ব্রাহ্মণ ও সংহিতা দুভাগে বিভক্ত। সংহিতা অংশে পদ্য ও ব্রাহ্মণ অংশে গদ্য রচিত। ঋগ্বেদে আচার্য গুরুকে বলা হত অগ্নিপ্রণেতা, যার অর্থ বিশেষভাবে শিক্ষিত। বৈদিক যুগে একটি সাধারণ বিশ্বাস প্রচলিত ছিল-উচ্চারণ ভুল হলে পাপ হতে পারে। তাই সঠিকভাবে মন্ত্র উচ্চারণের উপর জোর দেওয়া হত। বৈদিক যুগে অর্থহীন বাহ্যিক জ্ঞান গ্রহণযোগ্য ছিল না। বৈদিক যুগে শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো জাতিভেদ প্রথা ছিল না। এই যুগে নারীদের শিক্ষার সুযোগ ছিল; অনেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনে সমর্থ হতেন। এই বিদুষী মহিলারা ব্রহ্মবাদিনী নামে পরিচিত ছিলেন। বৈদিক যুগে কঠোর আত্মসংযম ও আত্মত্যাগ বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।

(5) পরবর্তী বৈদিক বা উপনিষদীয় যুগ

পরবর্তী বৈদিক যুগে বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিস্তারের সঙ্গে আত্মত্যাগমূলক অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হত এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ভারতীয় সমাজে উচ্চতর স্থান লাভ করত। পুরোহিতরা ছিলেন চার ধরনের। হোতা- তারা ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণের প্রার্থনা করতেন, উদ্‌দ্গাতা- এই ধরনের ব্রাহ্মণরা কিছু যজ্ঞের মন্ত্র আবৃত্তি করতেন, অধ্বর্য- এই পুরোহিতরা অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাবহারিক দিক সম্পাদন করতেন, ব্রহ্মা- অনুষ্ঠানের সমস্ত কাজগুলি লক্ষ রাখতেন। পরবর্তী বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ্য, আরণ্যক, উপনিষদ বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করে। পরবর্তী বৈদিক যুগে শিক্ষায় উপনিষদের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী বৈদিক যুগে শিক্ষার উদ্দেশ্য হল- সত্যজ্ঞান উপলব্ধি ও পরমব্রহ্ম লাভে সমর্থ হওয়া। শিক্ষা ছিল অন্তজ যোগসাধনা ও চিন্তনের প্রক্রিয়া। এই সময়ে গুরুকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। শিক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে ছিল- শ্রবণ (শিখন), মনন (যোগসাধনা), নিদিধ্যাসন (উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা)।

(6) ব্রাহ্মণ্য যুগ

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে বৈদিক শিক্ষার উন্নত রূপ ছিল। এই শিক্ষার সঙ্গে বাস্তব জীবনের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। গুরুর গৃহে থেকে শিষ্যরা পড়াশোনা করার সময় তারা গুরুর কাছ থেকে আত্মসংযম এবং আত্মশৃঙ্খলায় শিক্ষিত হত। এই যুগে মনে করা হত ধ্যান এবং যোগসাধনার মধ্য দিয়েই সঠিক জ্ঞানলাভ করা সম্ভব। আত্মোপলব্ধির মধ্য  দিয়েই এই জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। জ্ঞানলাভের জন্য শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করতে হত।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment