দেশীয় ভাষা সম্পর্কে মেকলের মন্তব্যগুলি ব্যাখ্যা করো। ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার সপক্ষে মেকলের যুক্তিগুলি বিবৃত করো

দেশীয় ভাষা সম্পর্কে মেকলের মন্তব্য
(1) শিক্ষার মাধ্যম: শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন দলের মতামত বিচার করে তাঁর অভিমত উপস্থাপন করেন। শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে তাঁর তিনটি মত ছিল-
দেশীয় ভাষা বা মাতৃভাষা, সংস্কৃত ও আরবি ভাষা এবং ইংরেজি ভাষা। দেশীয় ভাষা বা মাতৃভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন- দেশীয় ভাষাসমূহ অত্যন্ত দীন ও ঐশ্বর্যহীন তাই এই ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে একেবারেই অনুপযুক্ত। এই ভাষার শব্দসম্পদ এতই অনুপযুক্ত যে, পাশ্চাত্য ভাষায় লিখিত জ্ঞানবিজ্ঞানের বইগুলি দেশীয় ভাষায় অনুবাদ করা সম্ভব নয়। যে ভাষা এত দৈন্য, সে ভাষা পাশ্চাত্য শিক্ষার বাহন হতে পারে না, তবে এ কথাও ঠিক, বিস্ময়ের ব্যাপার হল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কোনো দলই মাতৃভাষাকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেন নি। বাকি রইল সংস্কৃত, আরবি এবং ইংরেজি ভাষা।
মেকলে বলেন, ‘প্রাচীন প্রাচ্য ভাষাসমূহ ইউরোপীয় ভাষাসমূহ অপেক্ষা নিকৃষ্টতর ও প্রমাদপূর্ণ।’ তিনি দম্ভভরে বলেছিলেন, ‘সমস্ত ভারত ও আরবে যে সাহিত্যসম্পদ আছে, ইউরোপীয় যে-কোনো একটি ভালো গ্রন্থাগারের একটি মাত্র তাকে যে সম্পদ রয়েছে, সেই সাহিত্যসম্পদের সঙ্গে তার তুলনা করা যায়।’ অবশেষে তিনি বলেন, “ইংরেজির মতো সম্পদশালী ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ যেখানে রয়েছে, সেখানে দুর্দশাগ্রস্থ ভারতীয় ভাষা যে ভাষায় ইংরেজি জ্ঞান- বিজ্ঞানের গ্রন্থরাজির সমকক্ষ একখানি গ্রন্থও নেই, সেই ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।” অর্থাৎ মেকলে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে পাশ্চাত্যবাদীদের সমর্থন করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, যে- “পাশ্চাত্য দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি পড়ানোর সুযোগ থাকতে ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র-যার বিধিবিধান নিকৃষ্টতার একটি সাধারণ গোবৈদ্যের জ্ঞানের তুল্য নয়, ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা যার কথা শুনলে স্কুলের সাধারণ মেয়েও হেসে উঠবে। ভারতীয় ইতিহাস-যাতে আছে ত্রিশ ফুট দীর্ঘ রাজার কাহিনী আর ত্রিশ হাজার বছরব্যাপী রাজত্বকালের নানান বিবরণ, যে দেশের ভূগোলে আছে ক্ষীরসাগর আর মধুসমুদ্রের কথা, সেই ভারতীয় বিদ্যার শিক্ষা দেওয়ার জন্য অর্থ ব্যয় করা মানে সরকারি অর্থের অপচয় করা।” ইংরেজি ভাষার সমর্থনে মেকলে লিখলেন- “ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অমূল্য অফুরন্ত খনি। ইউরোপীয় ভাষাসমূহের মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ ভাষা।
গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা যেমন ইউরোপে নবজাগরণের সূচনা করেছিল, তেমনই ইংরেজি ভাষা ভারতে এক নতুন যুগের সৃষ্টি করবে।” মেকলে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়াও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যচর্চার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন- ‘ভারতে ইংরেজ শাসক শ্রেণির ভাষা কিছুদিনের মধ্যেই প্রাচ্যে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলির বাণিজ্যের ভাষা হিসেবে গৃহীত হবে।” ভারতীয়দের সম্পূর্ণভাবে ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত করে তোলা সম্ভব এবং সরকারি শিক্ষা প্রচেষ্টারও সেই লক্ষ্যই থাকবে।
ইংরেজি শিক্ষার ফলে এদেশে এমন এক শ্রেণির মানুষ সৃষ্টি হবে, যারা বর্ণে ও রক্তেই শুধু ভারতীয় থাকবে, কিন্তু রুচি, মতামত নীতি ও বুদ্ধিতে হবে ইংরেজ। তিনি আরও পরামর্শ দেন যে, এইভাবে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে, সে শিক্ষার ফলশ্রুতি স্বাভাবিক নিয়মে সমাজের নিম্নস্তরে নেমে আসবে অর্থাৎ শিক্ষা নীচের দিকে নেমে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ তিনি ভারতে শিক্ষার ক্ষেত্রে চুঁইয়ে পড়া নীতি (Downward filtration theory) অনুসরণের সপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন।
ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার পক্ষে যুক্তি
মেকলে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার সপক্ষে অনেকগুলি যুক্তি দেখিয়েছিলেন। সেগুলি হল-
(1) ইংরেজি ভাষা পাশ্চাত্য ভাষাসমূহের মধ্যে প্রধান।
(2) গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা যেমন ইংরেজি ভাষার সমৃদ্ধির মূলে ছিল তেমনই ইংরেজি ভাষা ভারতীয় ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছিল।
(3) পাশ্চাত্য দেশে ইংরেজি ভাষা যথেষ্ট জনপ্রিয়, ইংরেজি ভাষা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাবিকাঠি।
(4) এই ভাষার মাধ্যমেই ভারতবাসী পশ্চিমদেশীয় সভ্যতার সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠবে।
(5) ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত না করতে পারলে ভারতবাসী সরকারি কাজকর্মেও অংশগ্রহণ করতে পারবেনা।
(6) ইউরোপে গ্রিস, রোমের বিদ্যা যেমন নবজাগরণ এনেছিল, ইংরেজি ভাষা তেমনই নবজাগরণ আনবে ভারতে ও ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায়।
(7) পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে ভারতবাসীরা সংস্কৃত অথবা আরবি- অপেক্ষা ইংরেজিকে অধিকমাত্রায় পছন্দ করে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর