কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালের চাহিদাগুলি কী কী
কৈশোরের চাহিদাসমূহ
(1) দৈহিক চাহিদা :
- যৌন চাহিদা : কৈশোরে ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌনশক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ দেখা যায়। এই সময় তাদের যৌনাঙ্গ পূর্ণতা লাভ করে। তাই তারা যৌন চাহিদা অনুভব করে। এই সময় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যে যৌন কৌতূহলগুলি দেখা যায়, সেগুলি সঠিকভাবে পরিতৃপ্ত হয় না। এর কারণ কিশোর-কিশোরীরা নিজেরা এই বিষয়ে সঠিকভাবে সচেতন নয়, পিতা- মাতারাও এই ব্যাপারে কিছু বলেন না, অন্যদিকে যৌন শিক্ষারও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই অনেকে ভুল কাজ করে ফ্যালে।
- খাদ্যের চাহিদা: এই সময় তাদের পুষ্টিকর খাদ্য ও শারীরিক অনুশীলনের প্রয়োজন হয়।
- সক্রিয়তার চাহিদা: কৈশোরে ছেলেমেয়েরা অধিক সক্রিয় হয়। তাদের মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করার একটা ইচ্ছা দেখা যায়। স্বাধীন চেতনাবোধ জাগ্রত হয়, তারা কর্মমুখর হয়ে উঠতে চায়।
(2) মানসিক চাহিদা :
- স্বাধীনতার চাহিদা: কিশোর-কিশোরীরা বয়স্কদের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায় এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে চায়। বাল্যের পরনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বনির্ভর হতে চায়। তারা মুক্তি চায়, সবকিছুকে নিজেদের মতো করে সাজাতে চায়। এই ধরনের চাহিদাকে স্বাধীনতার চাহিদা বলে।
- আত্মপ্রকাশের চাহিদা: কিশোর-কিশোরীরা স্বভাবতই আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়। এইরূপ মানসিক তাড়নায় তারা নিজেদেরকে অপরের সামনে তুলে ধরতে চায়। নিজ নিজ ক্ষেত্রে সৃষ্টি এবং সংস্কৃতিমূলক কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে চায়। তারা চায় সমাজের মানুষ তাদের চিনুক, জানুক এবং যোগ্যতার স্বীকৃতি দিক। এই ধরনের চাহিদাকে বলে আত্মপ্রকাশের চাহিদা।
- নিরাপত্তার চাহিদা : এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে হঠাৎ নানা পরিবর্তন আসে, ফলে তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং নিরাপত্তার অভাববোধ করে। এই কারণে তাদের মধ্যে নিরাপত্তার চাহিদা সৃষ্টি হয়। তাই বয়স্কদের কাছ থেকে তারা নিরাপত্তা পেতে চায়।
- জ্ঞানের চাহিদা: এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশের পূর্ণতা তাদের মানসিক শক্তিগুলিকে আরও শক্তিশালী ও পরিণত করে। ফলে তাদের কৌতূহল প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা প্রবল – হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কারের ঘটনা এই বয়সের শিক্ষার্থীদের মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
- দুঃসাহসিক অভিযানের চাহিদা: জ্ঞানের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অনেকসময় কিশোর-কিশোরীরা দুঃসাহসিক অভিযানে লিপ্ত হয়। সমবয়সি সদস্য বা বয়স্কদের সামনে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য এরা ঝুঁকি নিয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেয়।
- জীবনাদর্শের চাহিদা: কৈশোরে মানসিক চাহিদার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হল জীবনাদর্শের চাহিদা, অহংবোধ থেকে এই চাহিদা সৃষ্টি হয়, জীবন ও জগতের সম্পর্কে তাদের নানা মৌলিক প্রশ্ন জাগে। এইসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গিয়ে তারা আদর্শ (Ideal) সন্ধান করে। তাই এই সময় • শিক্ষক/ শিক্ষিকা এবং পিতা-মাতার ভূমিকা আদর্শস্থানীয় এবং অনুকরণযোগ্য হওয়া উচিত।
- আত্মনির্ভরতার চাহিদা: এই বয়সের ছেলেমেয়েরা অপরের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকাকে ঘৃণার চোখে দ্যাখে। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। স্বাধীনভাবে কাজ করে তারা স্বনির্ভর হতে চায়, স্বাবলম্বী হতে চায়।
(3) সামাজিক চাহিদা :
- সামাজিক স্বীকৃতির চাহিদা: কিশোর-কিশোরীরা নানা ধরনের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তা থেকেই এই বয়সিদের মধ্যে সামাজিক স্বীকৃতির চাহিদা স্পষ্ট হয়। এই চাহিদাকে কেন্দ্র করে সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্তকে মর্যাদা দেওয়া হোক এই হল তাদের অভিলাষ।
- নৈতিক চাহিদা: সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে নৈতিক চেতনাবোধ সৃষ্টি হয়। ঠিক-ভুল, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত তাদের মধ্যে স্পষ্ট হয়, এর ফলে তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়।
- সামাজিক অংশগ্রহণে চাহিদা: এই বয়ঃস্তরে ছেলেমেয়েরা পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর সমাজজীবনে প্রবেশ করে। তারা বৃহত্তর সমাজজীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চায় এবং সমাজের বিভিন্ন প্রকার কাজকর্মের সঙ্গে তারা ওতপ্রোতভাবে নিজেদের যুক্ত করতে চায়।
(4) প্রাক্ষোভিক চাহিদা: রাগ, অভিমান, আনন্দ, তৃপ্তি, স্নেহ, ভালোবাসা, ঈর্ষা, হিংসা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের প্রাক্ষোভিক বিকাশকে কেন্দ্র করে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে চাহিদার সৃষ্টি হয়, সেগুলি হল-
- হিতকর ও অহিতকর প্রক্ষোভ প্রকাশের চাহিদা: এই বয়সের শিক্ষার্থীদের অহিতকর প্রক্ষোভগুলি যেমন- রাগ, হিংসা, ঈর্ষা, হতাশা ইত্যাদির প্রকাশ যাতে না হয়, সেইজন্য তাদেরকে যথাযথভাবে নিরাপত্তা দিতে হবে। তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার, নিরাপত্তা দিতে গিয়ে তাদের মধ্যে অসামাজিক কাজকে প্রশ্রয় না দেওয়া হয়।
- স্বাধীনভাবে কাজ করার চাহিদা: বিভিন্ন ধরনের অহিতকর প্রক্ষোভ সৃষ্টির অন্যতম কারণ হল তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়া। এই চাহিদা পরিতৃপ্ত করার জন্য তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলে অযথা বাধা দেওয়া উচিত নয়।
- নাগরিকতার চাহিদা: এই বয়সের ছেলেমেয়েদের আত্মপ্রকাশের চাহিদা পরিতৃপ্ত না হলে বিভিন্ন ধরনের প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তাই এদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া উচিত।
- স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার চাহিদা : এই বয়সের ছেলেমেয়েরা স্নেহ, ভালোবাসা এবং প্রয়োজনে শ্রদ্ধা আশা করে। এই চাহিদা পরিতৃপ্ত না হলে তাদের মধ্যে রাগ, অভিমান, হতাশা ইত্যাদির মতো প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
- জ্ঞানের চাহিদা: জ্ঞানের চাহিদা যথাযথভাবে পরিতৃপ্ত না হলে বিভিন্ন ধরনের প্রাক্ষোভিক বিকাশ যেমন- আনন্দ, তৃপ্তিলাভ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ইত্যাদি প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়। আবার এই চাহিদা পরিতৃপ্ত না হলে বিরক্তি, অশ্রদ্ধা, রাগ ইত্যাদি প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
যৌন চাহিদা: যৌন চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য রাগ, হিংসা, ঈর্ষা, আক্রমণাত্মক মনোভাব ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের প্রক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে।