নব্য রাজতন্ত্র সম্পর্কে যা জানো লেখো

নব্য রাজতন্ত্র সম্পর্কে যা জানো লেখো

নব্য রাজতন্ত্র সম্পর্কে যা জানো লেখো
নব্য রাজতন্ত্র সম্পর্কে যা জানো লেখো

বিংশ শতকের প্রথম পর্বে বহু ইউরোপীয় ঐতিহাসিক নব্য রাজতন্ত্র ধারণাটির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। প্রথমেই জানা প্রয়োজন যে, নব্য রাজতন্ত্র কী? আসলে পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক নতুন ধরনের সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশে প্রথম আধুনিক জাতিরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে রাজতন্ত্র বিকাশলাভ করে, যা নব্য রাজতন্ত্র নামে পরিচিত।

ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে সপ্তম হেনরির রাজত্বকাল এক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। তাঁর সিংহাসন আরোহণ তথা টিউডর বংশের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ড মধ্যযুগ থেকে প্রবেশ করে আধুনিক যুগে। এসময় ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা হয়। পাশাপাশি সামন্ততন্ত্রের অবসান এবং শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। আসলে লুপ্ত রাজশক্তিকে পুনরুদ্ধার করে ইংল্যান্ডে শক্তিশালী ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র তথা টিউডর স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল সপ্তম হেনরির প্রধান উদ্দেশ্য। তাঁর প্রতিষ্ঠিত টিউডর রাজতন্ত্রকে নতুন বা নব্য রাজতন্ত্র (New Monarchy) বলে অভিহিত করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক জন রিচার্ড গ্রিন (John Richard Green) সর্বপ্রথম সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত নতুন প্রশাসনকে ‘নব্য রাজতন্ত্র’ -এই আখ্যা প্রদান করেছিলেন।

নব্য রাজতন্ত্র বলার কারণ

ইংল্যান্ডের টিউডর বংশের প্রতিষ্ঠার ঠিক পরপরই সপ্তম হেনরি (১৪৮৫-১৫০৯ খ্রি.) রাজার ক্ষমতা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি শিথিল প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বলাবাহুল্য তাঁর আমলে প্রতিষ্ঠিত নব্য রাজতন্ত্র অষ্টম হেনরির (Henry VIII) সময়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল।

নতুন শাসনব্যবস্থা

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জিওফ্রে এলটন (Geoffrey Elton) বলেছেন যে, সপ্তম হেনরির সিংহাসন আরোহণকালে যে প্রশাসনিক কাঠামোর অস্তিত্ব ছিল তাকে তিনি নবরূপ দান করে এক শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি গোলাপের যুদ্ধের পরবর্তীতে যে চরম অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে তিনি ইংল্যান্ডকে রক্ষার পাশাপাশি শাসনব্যবস্থায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হন।

পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা

পার্লামেন্টের সঙ্গে সপ্তম হেনরি সম্পর্ক ও নীতি ছিল বেশ চমকপ্রদ ও বৈপ্লবিক। তাঁর আমলে পার্লামেন্টে বেশকিছু আইন পাস করে সামন্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব হ্রাস এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ গৃহীত হয়। Livery ও Maintenance আইন দ্বারা সপ্তম হেনরি সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা খর্ব করে রাজার ক্ষমতা সুসংহত করতে উদ্যত হন। বলা যায় যে, স্বল্প সময়ের জন্য এবং সংখ্যায় কম পার্লামেন্ট ডাকলেও তার মধ্যেই পার্লামেন্টের মাধ্যমে তিনি যত সংখ্যক আইন প্রণয়ন করেছিলেন তা আগে কখনও হয়নি। ফলে পার্লামেন্টের গুরুত্ব এসময় যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। মেটল্যান্ড (Maitland) বলেছেন যে, সপ্তম হেনরির সময় আইন প্রণয়নের ব্যাপারে পার্লামেন্টের এই কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে নতুন ছিল, যা অষ্টম হেনরির সময় আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সামন্তদের দমন

রাজত্বের শুরু থেকেই সপ্তম হেনরি সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা সংকুচিত করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তাঁর শাসনকালে স্পেন, ফ্রান্স ও স্কটল্যান্ডের রাজপরিবারগুলির সঙ্গেই ইংল্যান্ডের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলস্বরূপ সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং টিউডর রাজবংশের মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধি পায়।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব

টিউডর আমলে ইংল্যান্ডে অভিজাত ও সামন্ত শ্রেণির ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজতন্ত্রের সমর্থকে পরিণত হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে ইংল্যান্ডের সমাজজীবনে বড়ো ধরনের পরিবর্তন সংঘটিত হয়।

চার্চ ও পোপের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক

চার্চ ও পোপের সঙ্গে টিউডর রাজাদের সম্পর্ক ও নীতির মধ্যেও নতুনত্ব ছিল। পোপের সঙ্গে সপ্তম হেনরির সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ, কিন্তু চার্চকে তিনি সম্পূর্ণ নিজ আয়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন। ফলে অষ্টম হেনরির সময় রিফরমেশনের পথ সুগম হয়েছিল।

সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা প্রণয়ন

সপ্তম হেনরি ইংল্যান্ডে সামন্ত শ্রেণির প্রভাবমুক্ত এক সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা প্রণয়নে সচেষ্ট হন। এই সময় ইংল্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে সপ্তম হেনরি বিচারব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।

জাতীয়তাবাদের উন্মেষ

পোলার্ড (Pollard) মনে করেন, সপ্তম হেনরির সময় ইংল্যান্ডে প্রথম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ইতিমধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধ ও তার দরুন সৃষ্ট অরাজকতার পরিবেশে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। সর্বস্তরের মানুষ একজন শক্তিশালী শাসকের অধীনে শান্তিতে বসবাস করতে চাইছিলেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে সপ্তম হেনরি ও অষ্টম হেনরির সুদৃঢ় শাসনকে জনগণ স্বাগত জানায়।

জাতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা

টিউডর রাজারা পার্লামেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন আইন পাস করে ইংল্যান্ডকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। অষ্টম হেনরির রিফরমেশন পার্লামেন্টে অ্যাক্ট অফ অ্যাপিলস (Act of Appeals, ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ) পাস করে ইংল্যান্ডকে সাম্রাজ্য বলে ঘোষণা করা হয়। একের পর এক আইন পাস করে ইংল্যান্ডের চার্চের উপর থেকে রোমের পোপের কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

ধর্মসংস্কার আন্দোলন

ইটালিতে নবজাগরণের যে ধারার সূচনা হয়, তা কালক্রমে ইংল্যান্ডেও প্রভাব বিস্তার শুরু করে। এর সূত্রে মানুষ মধ্যযুগীয় ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে থাকে। টিউডর রাজবংশের আমলে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হলে ইংরেজি অক্ষরে ছাপা বাইবেল সহজলভ্য হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ ধর্মের প্রকৃত সত্যের প্রকাশ মানুষের মনোজগৎ ও চিন্তাজগতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে- প্রশস্ত হয় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথ। আলোচ্য পর্বে ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ধর্মের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত স্থায়িত্ব লাভ করে।

ঔপনিবেশিক বিস্তার 

১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইংল্যান্ডের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে আমেরিকার উপর। এরপর ইংল্যান্ড নতুন বিশ্ব আমেরিকায় উপনিবেশ বিস্তার শুরু করে। ফলে সপ্তম হেনরির আমল থেকে সাম্রাজ্যবিস্তারের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে একথা বলাই যায় যে, সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রে যে অভিনবত্ব ছিল তা লক্ষ করে তাকে নতুন রাজতন্ত্র বললে ভুল হবে না। পরবর্তীকালে অষ্টম হেনরির পরামর্শদাতা টমাস ক্রমওয়েল উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে নব্য রাজতন্ত্রের আদর্শকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment