শ্রীমদ্ভগবতগীতা – নিষ্কাম কর্মের ধারণা প্রশ্ন উত্তর

1. অর্জুনকে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদনের জন্য বেদের কোন্ কান্ডের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে?
বেদের দুটি কান্ড। যথা- কর্মকান্ড ও জ্ঞানকান্ড।
কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন করার কথা বলা হয়। তার ফলে ব্যক্তিকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয়। অপরদিকে জ্ঞানকাণ্ডে বলা হয়, আত্মজ্ঞানের উদয় হলে সকল কর্মের ফল বিনষ্ট হয়। আর তার ফলে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না।
অর্জুনকে এইরূপ উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে কর্মবাদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কর্ম করলে তা প্রয়োজন সিদ্ধ করে ঠিকই কিন্তু সেটি ক্ষুদ্র জলাশয় তুল্য। জ্ঞানকাণ্ডের দ্বারা মুক্তি প্রাপ্ত হলে তা হল হ্রদের সমান। ক্ষুদ্র জলাশয়ের জলেও পানের যোগ্য আবার বৃহৎ জলাশয়ের জলও পানের যোগ্য। কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি হলে সে বৃহৎটাকেই গ্রহণ করবে। অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম করার জন্য আমাদের বেদের জ্ঞানকান্ডের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিৎ। এজন্য অর্জুনকে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদনের জন্য বেদের জ্ঞানকাণ্ডের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
2. আত্মজ্ঞান সহযোগে নিষ্কাম কর্ম বলতে কি বোঝো? অথবা, আত্মতত্ত্বের জ্ঞানযুক্ত ব্যক্তিরা কীভাবে নিষ্কাম কর্ম করতে পারে?
কাম্যবিষয় পাওয়ার জন্য কর্ম করে যদি কাম্যবিষয় লাভ করে তাহলে ব্যক্তির সুখ উৎপন্ন হয় নচেৎ দুঃখ। কিন্তু যদি কামনা ব্যতিরেকে কোনো প্রকার প্রত্যাশা না রেখে ব্যক্তি কর্ম করে তাহলে সুখ বা দুঃখ উৎপন্ন হয় না।
আত্মজ্ঞানের উদয় হলে ব্যক্তি বুঝতে পারে পরমাত্মাই জগতের মূল বিষয়, পরমাত্মার অতিরিক্ত কোনো বিষয় নেই। এই মূল বিষয়টি যে জেনে যাবে তার আর কোনো বিষয়ে আসক্তি জন্মাবে না। আত্মার স্বরূপ বিষয়ে জানলে জাগতিক বিষয়ের প্রতি কোনোরূপ আসক্তি জন্মায় না এবং কামনার উদয়ও হয় না এবং কামনা না জন্মালে কামনাজনিত ফলভোগ উৎপন্ন হয় না ফলত সংসারে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না। এইরূপ আত্মতত্ত্বের জ্ঞানযুক্ত ব্যক্তিরাই নিষ্কাম কর্ম করতে পারে।
3. নিষ্কাম কর্মের অধিকারী কে?
কামনা-বাসনাশূন্যভাবে কর্ম সম্পাদন করা কোন্ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব অর্থাৎ নিষ্কাম কর্মের অধিকারী কারা? এই প্রশ্নের উত্তরে গীতায় দুই প্রকার বুদ্ধির উল্লেখ আছে – বাসনাত্মিকা এবং ব্যবসায়াত্মিকা। বাসনাত্মিকা বুদ্ধি নিম্নাভিমুখী। এইপ্রকার বুদ্ধিবিশিষ্ট ব্যক্তির সমস্ত কর্ম কামনার অনুবর্তী হয়। এই প্রকার বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ফলাকাঙ্ক্ষা ছাড়া কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয় না। অপরপক্ষে, ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি ঊর্ধ্বাভিমুখী এবং এই প্রকার বুদ্ধিবিশিষ্ট ব্যক্তিই একমাত্র যোগস্থ হয়ে ঈশ্বরে নিজ বুদ্ধি সমর্পণ করে সকল কর্মকেই ঈশ্বরের কর্ম বলে মনে করতে পারেন। এই প্রকার ব্যক্তিকেই গীতায় স্থিতধী বা স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়েছে। যিনি সুখ ও দুঃখে সমভাবাপন্ন এবং রাগ, অনুরাগ ও ভয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এইরূপ ব্যক্তিই নিষ্কাম কর্মের অধিকারী।
4. নিবৃত্তি মার্গ ও প্রবৃত্তি মার্গ কী?
জ্ঞানবাদী সাংখ্যগণ নিবৃত্তি মার্গ অনুসরণের কথা বলেছেন। নিবৃত্তি মার্গ অনুসারে বলা হয় সর্বকর্ম ত্যাগপূর্বক অর্থাৎ সমস্ত কর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণই শ্রেয়। যদিও শ্রীকৃয় অর্জুনকে কর্মের দিক থেকে নিবৃত্তি মার্গ বর্জন ও ফলভোগের দিক থেকে নিবৃত্তি মার্গ গ্রহণের কথা বলেছেন।
প্রাচীন ভারতে কর্ম প্রসঙ্গে দুটি মার্গ বা পথের উল্লেখ আছে – তার একটি হল প্রবৃত্তি মার্গ। কর্মবাদী মীমাংসকগণ প্রবৃত্তি মার্গ অনুসরণ করেন। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কাম্যফল লাভের জন্য অনুসরণীয় পথ হল প্রবৃত্তি মার্গ। যদিও শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্মের দিক থেকে প্রবৃত্তি মার্গ গ্রহণ ও ফলভোগের দিক থেকে নিবৃত্তি মার্গ বর্জনের কথা বলেন।
5. গীতায় বর্ণিত দুই ধরনের কর্মকৌশল আলোচনা করো।
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে যে নিষ্কাম কর্ম পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন তাই বর্ণিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে গীতায় দুটি কর্মকৌশলের কথা বলা হয়েছে। যথা-
(a) নিরবচ্ছিন্ন কর্মপালন এবং(b) কর্মফলে আসক্তি ত্যাগ।
(1) নিরবচ্ছিন্ন কর্মপালন: কোনো মানুষই কর্মহীনভাবে জীবনযাপন করতে পারেন না। অর্থাৎ নিঃশেষে কর্মত্যাগ করা কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ এতে জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। গীতাতেও কর্মহীনতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি, বরং কর্মত্যাগ না করে কর্মফলের প্রতি আসক্তি, ফললাভের আকাঙ্ক্ষা, কর্তৃত্ববোধ, মমত্ববোধ পরিত্যাগ করে কর্ম করতে বলা হয়েছে।
(2) কর্মফলে আসক্তি ত্যাগ: গীতায় অপর যে কর্মকৌশলের কথা বলা হয়েছে তা হল কর্মফলে আসক্তি ত্যাগ। আসক্তির কারণ হল মানুষ নিজেকে কর্মের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলে এবং তার ফলে দুঃখবোধ জন্মায়। স্বার্থবোধ বা স্বার্থপরযুক্ত চিন্তা ও কাজ আমাদের কোনো-না- কোনো বিষয়ে আসক্ত করে এবং আমরা সেই বিষয়ের দাসে পরিণত হই। তাই গীতায় কামনা-বাসনা ত্যাগপূর্বক অর্থাৎ আসক্তি ত্যাগ করে কর্ম করতে বলা হয়েছে।
6. কর্ম কী? কর্ম, অকর্ম ও বিকর্ম কী?
সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে ‘কর্ম’ শব্দের উৎপত্তি। কর্ম বলতে সব রকম কাজকে বোঝায়- ভালো, মন্দ কিংবা স্বার্থবিহীন কর্ম। কর্ম হল মানুষের ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ। সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’-এ কর্মকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- কর্ম, অকর্ম এবং বিকর্ম।
(1) কর্ম: যে কর্ম মানুষ অপরের প্রতি এবং উপকারের জন্য করে তাকে সনাতন দর্শনশাস্ত্র মতে বলে কর্ম।
(2) বিকর্ম: যে কর্ম শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য সম্পাদন করা হয় সেটি হল বিকর্ম।
(3) অকর্ম: যে কর্ম শুধুমাত্র কর্তব্য রূপে সম্পাদন করা হয় বা যেখানে কোনো ফলের আশা নেই, তাকে সনাতন দর্শনশাস্ত্র মতে বলে অকর্ম। এই প্রকার হল নিষ্কাম কর্ম।
7. সকাম কর্মের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
রাগ, দ্বেষ, মোহ, কামনা-বাসনাযুক্ত কর্ম হল- সকাম কর্ম। সকাম কর্মের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
1.সকাম কর্ম ফল উৎপাদন করে, যা কর্মকর্তাকে ভোগ করতে হয়।
- সকাম কর্মে ফলভোগ ইহজীবনে সম্পন্ন না হলে সেই ফলভোগের জন্য পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয়।
3.সকাম কর্মের ক্ষেত্রে কর্তার মনে ‘আমিই কর্তা’ – এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান থাকে।
- সকাম কর্ম কোনো ফলের আকাঙ্ক্ষার জন্য কর্মকর্তা দ্বারা কৃত হয়।
5.সকাম কর্ম দ্বারা মুক্তি লাভ করা সম্ভব হয় না।
6.সংসারে আবদ্ধ জীবের কর্ম হল সকাম কর্ম।
8. ফলের আশায় যারা কর্ম করে তাদের ‘অতিহীন’ কেন বলা হয়েছে?
সকাম কর্ম অত্যন্ত নিকৃষ্ট। সকল কর্মের মধ্যে নিষ্কামভাবে সমবোধই হল শ্রেষ্ঠ কর্ম। কর্মে সমবোধ থাকাই হল সঠিক কৌশল। কারণ কর্মে যদি সমতাবোধ না থাকে তাহলে ব্যক্তির মধ্যে অহং ও মমত্ববোধ আসে। আর এই অহংবোধ ও মমত্ববোধ হল পশুবুদ্ধির সমান যা ব্যক্তিকে অতিহীন করে তোলে।
যেমন আলোর প্রকাশ ও অন্ধকার কখনোই সমকক্ষ হতে পারে না তেমনি নিষ্কাম কর্ম ও সকাম কর্ম কখনোই সমকক্ষ হতে পারে না। দুটির মধ্যে দিন রাত্রির মতো বিরাট পার্থক্য বর্তমান। কারণ ফলের আশা না করে কর্ম করলে পরমপ্রাপ্তি হয়। ফলের আশা রেখে কর্ম করলে অতিহীন হয়ে পড়তে হয়। সকাম কর্মের ফলে ব্যক্তি জন্ম-মৃত্যুচক্রে আবর্তিত হয়। এজন্য ফলের আশা রেখে কর্ম করাকে অতিহীন বলা হয়েছে।
9. নিষ্কাম ও সকাম কর্মের মধ্যে পার্থক্য কী?
নিষ্কাম কর্ম ও সকাম কর্মের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্যগুলি লক্ষ করা যায়।
- প্রথমত: সকাম কর্মকে কাম্য কর্মও বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, কাম্য কর্ম বা সকাম কর্ম ফল প্রসব করে। নিষ্কাম কর্মে কর্মফল ভোগ নেই। এ কারণে কাম্যকর্মকে কর্মযোগ বলা যায় না। নিষ্কাম কর্মই কর্মযোগ।
- দ্বিতীয়ত: যাগযজ্ঞ, তপস্যা ইত্যাদি হল কাম্যকর্ম। এইসব কর্ম ফলপ্রসব করে। তাই এই কর্ম সুসম্পন্ন না হলে ব্যর্থ হয়। কাজটি পুনরায় আরম্ভ করতে হয়। নিষ্কাম কর্ম কখনো ব্যর্থ হয় না।
- তৃতীয়ত: কাম্যকর্ম কেবল ব্যর্থই হয় না কখনো কখনো তা পাপেরও কারণ হয়। যখন অপরকে প্রবঞ্চনা বা প্রতারণা করা হয়, তখন তা পাপের কারণ হয়। যজ্ঞানুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হলে সেটিও ওই যজ্ঞে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের ক্ষতির কারণ হয়। নিষ্কাম কর্মে ফলের আকাঙ্ক্ষা না থাকায় এইরূপ কর্ম প্রতারণামূলক বা দূরভিসন্ধিমূলক হতে পারে না এবং ক্ষতির কারণ হয় না।
- চতুর্থত: কাম্যকর্মে বুদ্ধি বহিমুখী হয়। অন্তর্মুখী না হলে বুদ্ধি পরমাত্মায় একনিষ্ঠ হতে পারে না। তার ফলে কামনার অন্ত থাকে না। সেই অনন্ত কামনার তৃপ্তি সাধনও সম্ভব হয় না। অপরপক্ষে নিষ্কাম কর্মে নিজের বুদ্ধি ঈশ্বরের মধ্যে যুক্ত থাকে বলে সেই বুদ্ধি একনিষ্ঠ হয়- নানাদিকে ধাবিত হয় না।
- পঞ্চমত: কাম্যকর্মে নানা প্রকার আয়োজনের প্রয়োজন হয়। তাই তা ব্যয় ও সময় সাপেক্ষ। অপরপক্ষে নিষ্কাম কর্মে আয়োজন বা অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না।
10. কর্মযোগ কী?
ভারতীয় দর্শনে মোক্ষলাভের যে তিনটি পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে প্রধান দুটি পথ হল – জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ। এদের মধ্যে জ্ঞানযোগের দ্বারা মুক্তিলাভ করা সম্ভব একমাত্র সিদ্ধ পুরুষদের পক্ষেই। সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। কাজেই সাধারণ মানুষ যারা জ্ঞানযোগে সিদ্ধ নয় তাদের মুক্তিলাভের একমাত্র পথ হল কর্মযোগ।
কর্মযোগ হল নৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত কর্ম। একজন কর্মযোগী যখন কর্ম করেন তখন তিনি তার নিজের স্বার্থ এবং আগ্রহকে গুরুত্ব দেন না। পরিবর্তে তিনি জগতের সমস্ত প্রাণী, প্রকৃতির সকল পদার্থকে পক্ষপাতহীন হিসেবে বিবেচেনা করেন। কর্মযোগের অর্থ আবেগ কিংবা বাসনার বিসর্জন নয়, বরং এর অর্থ মানসিক স্থিরতা ও সমদৃষ্টি দ্বারা পরিচালিত হয়ে কর্ম সম্পাদন করা। সুতরাং বলা যায়, কর্মযোগ হল এমন এক কর্মপদ্ধতি, যার সাহায্যে কর্মকৌশল সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করে, কামনা-বাসনা ত্যাগ পূর্বক কর্মানুষ্ঠান করে সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্থাৎ মোক্ষলোভ করা যায়।
11. গীতায় কর্মযোগের যে তিনপ্রকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা আলোচনা করো।
গীতায় কর্মযোগের যে তিন প্রকার ব্যাখ্যা পাওয়া তা নিম্নরূপ-
প্রথম ব্যাখ্যা: “সমত্বম্ যোগঃ উচ্যতে” (২/৪৮), অর্থাৎ যোগী বা স্থিতধী ব্যক্তি কর্মের সফলতায় যেমন আনন্দিত হন না, তেমনি বিফলতাতেও বিষাদগ্রস্ত হন না। তিনি সব পরিস্থিতিতেই অবিচল থাকেন।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা: “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্” (২/৫০) অর্থাৎ যোগের কৌশলের দ্বারা সকল পরিস্থিতিতে সমতাভাব বজায় রেখে মুক্তির দিকে ধাবিত হওয়াই হল কর্মযোগ।
তৃতীয় ব্যাখ্যা: “যোগঃ দুঃখ সংযাগ বিয়োগঃ” (৬/২৩) অর্থাৎ ‘যোগ’ বলতে সর্বপ্রকার দুঃখ থেকে বিযুক্ত হওয়াকে বোঝায়। যিনি যোগী (কর্মযোগী) তাকে কোনো দুঃখ স্পর্শ করে না।
12. যোগস্থ কর্ম বলতে শ্রীকৃষ্ণ কী বুঝিয়েছেন?
যোগস্থ কর্ম
যোগস্থ কর্ম বলতে শ্রীকৃষ্ণ বলতে চেয়েছেন, কামনা-বাসনা, কর্তৃত্বাভিমান পরিত্যাগ করে নিজ বুদ্ধিকে ঈশ্বরে সমর্পণ করে একনিষ্ঠ চিত্তে ঈশ্বরের কর্ম সম্পাদন করা।
‘যোগস্থ’ শব্দের একাধিক অর্থ হতে পারে। যথা- কেবল ‘ঈশ্বর তুষ্ট হবেন’ এই অভিপ্রায়ে ঈশ্বরকে আশ্রয় করে কর্ম করা, নিষ্কাম কর্মযোগে স্থিত হয়ে কর্ম করা, সমত্ববুদ্ধি যুক্ত হয়ে কর্ম করা। এই তিনটি অর্থ হল কর্মযোগের সারকথা।
(1) প্রথম অর্থ : ‘যোগস্থ’ শব্দের প্রথম অর্থ হল পরমেশ্বরে যুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। প্রত্যেক কাজ করবার সময় মনে করতে হবে যে ঈশ্বরের কাজ করছি। সকলই তার ইচ্ছা। ঈশ্বরের ইচ্ছা যেন আমাদের কর্মের প্রবর্তক হয়।
(2) দ্বিতীয় অর্থ: ‘যোগস্থ’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থ হল কর্মফলের প্রতি নিরাসক্ত হতে হবে। ‘আমি কর্তা’ এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান থাকবে না এবং এই অবস্থায় ব্যক্তির কর্মফলের প্রতি আসক্তি বা ‘এই কর্মের এই ফল পাওয়া চাই’-এইরূপ আকাঙ্ক্ষা থাকবে না।
(3) তৃতীয় অর্থ: তৃতীয় অর্থ অনুযায়ী ‘যোগস্থ’ শব্দের অর্থ হল সমত্ববুদ্ধি লাভ করা। অর্থাৎ ব্যক্তিকে কর্মের সফলতা ও নিষ্ফলতাকে সমান মনে করতে হবে। কর্মে সফল হলে তিনি হৃষ্ট যেমন হবেন না তেমনি আবার বিফল হলেও বিষণ্ণ হবেন না। এইভাবে সিদ্ধি এবং অসিদ্ধিতে সমত্বকেই যোগ বলা হয়।
13. কর্মযোগের উপযোগিতা কী? অথবা, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় কর্মযোগের ওপর এত গুরুত্ব আরোপ করার কারণ কী?
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদনের কথা বলছেন অর্থাৎ কর্মের পরিণামের কথা না ভেবে শুধুমাত্র কর্তব্য মনে করে কর্ম সম্পাদন করতে বলেছেন। পৃথিবীতে এমন কিছু কর্ম রয়েছে যা শুভ কর্ম এবং তার ফল সুখ প্রদায়ক। কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে যে, যদি ভালো কর্ম করে সুখ পাওয়া যায়, তবে ব্যক্তি নিষ্কাম কর্ম করবে কেন? এর উত্তরে বলা যায়, সকল ভোগ্য বস্তুই হল দুঃখ প্রদায়ক। জগতে কোনো সুখই শুদ্ধ নয়। সকল সুখের সাথেই দুঃখমিশ্রিত থাকে। তবে একমাত্র নিষ্কাম কর্ম রাগ ও দ্বেষ ব্যতিরেকে করা হয় বলে তা দুঃখ বা সুখ, পাপ বা পূণ্য কিছুই উৎপন্ন করে না।
সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্মের মধ্যে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করতে বলার পেছনে মূল কারণ হল নিষ্কাম কর্ম ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জিত হওয়ায় ও ঈশ্বরে সমর্পিত হওয়ায় এই কর্মের কর্তাকে এর ফলভোগ করতে হয় না। ফলে কর্মের ফলভোগ করার জন্য পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে ও তার জন্য নতুন করে দেহধারণ করতেও হয় না। দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। সকল প্রকার দুঃখ থেকে চিরকালের মতো মুক্তি অর্থাৎ মোক্ষ লাভ হয়। তাই গীতায় কর্মযোগ বা নিষ্কাম কর্মের প্রতি এত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
14. কর্মযোগকে কোন দুটি অর্থে বুঝতে হবে?
কর্মযোগকে যে দুটি অর্থে বুঝতে হবে তা হল – প্রথম অর্থে প্রাথমিক স্তরের সেই সংগ্রামকে বোঝায় যখন শিষ্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সঙ্গে নিজেকে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্ম থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হয়। দ্বিতীয় অর্থে পরবর্তী সেই স্তরকে বোঝায় যখন তত্ত্বজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের উদয় হওয়ার ফলে সংগ্রামের অবসানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎ আচরণ দেখা দেয়। প্রথম অর্থে কর্মযোগ সহায়ক রূপে গণ্য হয়। ভগবদ্গীতার মূল বিষয়বস্তু – দ্বিতীয়টি। এটি প্রায়সই আধ্যাত্মিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের বৈশিষ্ট্যরূপে প্রতিভাত হয়।
15. কর্মযোগী কীভাবে অবস্থান করেন? অথবা, কর্মযোগীর সঙ্গেঙ্গ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের তুলনা করেছেন কেন?
কর্মযোগী কীভাবে ইন্দ্রিয় সংযমের অনুশীলন করেন তা বোঝাতে গিয়ে গীতায় উদাহরণস্বরূপ কচ্ছপের উপমা প্রয়োগ করা হয়েছে। কচ্ছপ যেমন আপন অঙ্গসমূহকে সংবরণ করে নেয়, সেইরূপ যিনি ইন্দ্রিয়াদির বিষয় থেকে নিজ ইন্দ্রিয়দিকে সর্ব প্রকারে সংবরণ করেন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ হন।
কচ্ছপ যখন চলে তখন তার ছয়টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা যায়- চারটি পা, একটি লেজ, একটি মস্তক কিন্তু যখন সে অঙ্গগুলি লুকিয়ে ফেলে তখন কেবল পৃষ্ঠদেশ দেখা যায়। ঠিক তেমনি স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি কচ্ছপের ন্যায় পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মন- এই ছয়টিকে নিজ নিজ বিষয় হতে সংহত করে – অবস্থান করেন। এইভাবেই কর্মযোগী অবস্থান করেন।
16. আসক্তির কারণে যদি কর্ম বন্ধন হয় তাহলে গীতায় কর্ম করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে কেন?
কর্ম করলে বন্ধন থাকবে কি থাকবে না তা কর্মকর্তার ওপর নির্ভর করে। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ কর্ম করা ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। গীতায় ‘সংকল্পের বা ইচ্ছার স্বাধীনতা’-কে স্বীকার করা হয়েছে। তাই সংকল্পবদ্ধ কর্মের প্রতি যদি কর্তাভাব থাকে, তাহলে সেই কর্ম ইষ্ট, অনিষ্ট, ও মিশ্র – এই তিনধরনের ফল দেয়। কিন্তু যে কর্মে ‘আমি কর্তা নই’ – এমন মনোভাব থাকে সেই কর্ম বন্ধনকারক হয় না। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-য় স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে নিষ্কাম কর্ম অর্থাৎ আসক্তিমুক্ত হয়ে কর্ম করলে, মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে। আসক্তিমুক্ত হয়ে, সকল জীবের প্রতি অহিংসা, করুণা, সত্য, সৎভাবনা, পরোপকার ইত্যাদি মনোভাব রেখে কাজ করলে মানুষের মধ্যে ‘দেবত্ব গুণ’-এর আগমন ঘটে।
17. কর্ম-বন্ধন থেকে মুক্তির উপায় লেখো।
কর্মফল ভোগের জন্য জীবকে পুনঃ পুনঃ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্ত হতে হয় এবং জরা-ব্যাধি যুক্ত হয়ে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। এর নাম কর্মবন্ধন।
কর্মবন্ধন থেকে মুক্তির জন্য যে ব্যক্তি সাধন-চতুষ্টয় এর দ্বারা আত্মজ্ঞান অনুধাবন করে বিচারপূর্বক সমাহিত হয়েছেন অর্থাৎ ‘আমি ব্রহ্ম’- এই জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনিই এই দেহেই মুক্তিলাভ করে জীবন্মুক্ত হন এবং বর্তমান দেহের মৃত্যুর পর বিদেহমুক্ত হন। তার আর জন্ম হয় না। নিষ্কাম কর্ম করলে মানুষ সংসারবন্ধন অর্থাৎ কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হবে, তাকে পুনরায় আর জন্মগ্রহণ করতে হবে না। ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যে কর্ম করা হয় তাই নিষ্কাম কর্ম। সুতরাং নিষ্কাম কর্ম কর্মবন্ধন থেকে মুক্তির উপায়।
18. সাধন-চতুষ্টয় কী?
সাধন-চতুষ্টয়
মুক্তি লাভ বা মোক্ষলাভ করবার জন্য ‘সাধন- চতুষ্টয়’ বা চার প্রকার সাধনার কথা বলা হয়। এই পথে চারটি ধাপ রয়েছে। সেগুলি হল- সমন্যাস, শ্রবণ মনন, এবং ধ্যান।
(1) সমন্যাস: সমন্যাস হল ব্যক্তির মধ্যে চারটি গুণের বিকাশ। এই চারটিগুণ হল-
- বিবেক: কোন্ বস্তু নিত্য ও কোন্ বস্তু অনিত্য বা অস্থায়ী সেই বিচার।
- বৈরাগ্য: ত্যাগের ভাব ও জাগতিক সুখ ও দুঃখ সম্পর্কে বিতৃয়া।
- ষট্ সম্পত্তি: ছয়টি গুণ- শম্ (মানসিক শান্তি), দম (ইন্দ্রিয় সংযম) উপরতি (জাগতিক ক্রিয়াকর্ম থেকে নিষ্কৃতি), তিতিক্ষা (প্রতিকূল অবস্থাতেও শান্ত থাকা), শ্রদ্ধা (ঈশ্বর বিশ্বাস), সমাধি (মনের বাইরে যাওয়া)।
- মুমুক্ষুত্ব: মুক্তিলাভের ইচ্ছা।
- শ্রবণ: বেদ ও আচার্যের উপদেশ শোনা।
- মনন: বেদ ও আচার্যের উপদেশ স্মরণ করা।
- ধ্যান: ‘তুমিই সেই’- এই মহাবাক্য উপলব্ধি করা।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর