হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা - মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

হারিয়ে যাওয়া তো অনেক রকমের হয়। আক্ষরিক অর্থে ধরতে গেলে হারিয়ে যাওয়া একটা নেতিবাচক শব্দ। প্রতিদিন কত মানুষ হারিয়ে যায়। জীবন হারিয়ে যায় মৃত্যুর অন্ধকারে। স্বপ্ন হারায় বাস্তবের কড়া আঁচে। সততা পথ হারায় অসহায়তার কানাগলিতে। কিন্তু অন্ধকার তো মানুষের জীবনের শেষকথা হতে পারে না। তাই হতাশার অন্ধকারে দিশেহারা মানুষ আবার জীবনকে ফিরে পেতে মনে মনে নতুন করে পথ হারায় আশার প্রদীপ হাতে।

"কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে,
মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে।"...

মনে মনে হারিয়ে যেতে কে না ভালোবাসে! এ তো আর জীবনের জটিল পথে হারিয়ে যাওয়া নয়, কিংবা হারিয়ে যাওয়া নয় বিস্মৃতির গহ্বরে। হারিয়ে যাওয়া মানে মনে মনে পাড়ি দেওয়া কল্পনার রাজ্যে। তাই এই হারিয়ে যাওয়ায় নেই কোনো মনখারাপ, নেই কোনো বিদায়কালীন বিষাদ। বরং রয়েছে অজানাকে জেনে নেওয়ার, পুরোনোকে নতুন করে চিনে নেওয়ার আনন্দ।

দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা আর কর্মমুখরতায় ক্লান্ত মানুষের মন ছুটি খোঁজে। কিন্তু নাগরিক জীবনে চাইলেই কী আর ছুটি মেলে! তাই মন তখন হারিয়ে যেতে চায় মনে মনে। বাস্তব জীবনে ব্যস্ত, ক্লান্ত মানুষ মনে মনে পাড়ি দেয় তার স্বপ্নের জগতে, কুড়িয়ে নেয় তার কল্পনার চকমকি পাথর। তখন দিনদুপুরে ব্যস্তবাগিশ শহরটাও হয়ে ওঠে নিঝুম নিশ্চিন্দিপুর। নিজের সঙ্গে নিজের মতো সময় কাটিয়ে, তারপর আবার দিব্যি ফিরে আসা যায় বাস্তবের দুনিয়ায়। গতানুগতিক জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে জীবনে আসে নতুনত্বের ছোঁয়া।

প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝে একটু অবসর খোঁজে মানুষ। সেই অবসরটুকুকে সে ভরিয়ে তোলে নিজের শখ-শৌখিনতা দিয়ে, হারিয়ে যায় নিজের ভালোলাগার জগতে। কেউ হারিয়ে যায় রংতুলির আঁচড়ে, কেউ-বা বইয়ের পাতায়; কেউ নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায় প্রকৃতির মাঝে; কেউ আবার নিজের অবসরটুকু ভরিয়ে তোলে সেলুলয়েডের প্রতিফলনে। আর এই হারিয়ে যাওয়াই জন্ম দিয়েছে পৃথিবীর শিল্পকর্মগুলির। একজন শিল্পী যখন হারিয়ে যান তাঁর নিজের মধ্যে, তখনই জন্ম হয় নতুন নতুন সৃষ্টির।

হারিয়ে যাওয়া মানে কিন্তু বাস্তব থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, মনের জানলা-দরজাগুলো খুলে দেওয়া; যাতে তাজা বাতাস এসে মনকে সজীব রাখতে পারে; মনে আসে আরও উৎসাহ, আরও উদ্দীপনা। একজন কাজপাগল মানুষ কাজ থেকে পালাতে নয়, হারিয়ে যেতে চায় নিজের কাজের মধ্যেই। তাই মাঝে মাঝে চারপাশের চেনা পরিবেশ থেকে কিছু সময়ের জন্য শারীরিক বা মানসিকভাবে অচেনায় হারিয়ে যেতে চায় সকলেই; ফিরে আসতে চায় নতুন উদম্যে পথ চলার কিছু রসদ নিয়ে।

জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং জীবনকে আরও গভীরভাবে বোঝার জন্য প্রয়োজন হারিয়ে যাওয়া। তাই নেতিবাচক নয়, ‘হারিয়ে যাওয়া’ আসলে বৃহত্তর অর্থে এক ইতিবাচক প্রকাশ।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment