বাল্যকালের বিকাশমূলক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
বাল্যকালের বিকাশমূলক বৈশিষ্ট্যসমূহ
বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(1) দৈহিক বিকাশ: দৈহিক বিকাশগুলি হল নিম্নরূপ-
- দৈহিক উচ্চতা: 6 থেকে 11 বছরের শিশুদের এই স্তরের প্রথম দিকে উচ্চতা বৃদ্ধির হার কমে যায়। 10 বছরের পর মেয়েদের উচ্চতা খুব বেশি হারে বাড়ে। তবে এই স্তরের শেষের দিকে দৈহিক বৃদ্ধি হয় না বললেই চলে।
- ওজন: এইসময় ওজন বৃদ্ধির হার অপেক্ষাকৃত কম থাকে, তবে 11 বছরের পর ওজন বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে।
- দৈহিক কাঠামো: দৈহিক কাঠামো ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। দেহের নীচের দিকে বিকাশ তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
- স্নায়ুতন্ত্রের সংগঠন বৃদ্ধি: 6-8 বছর বয়স পর্যন্ত স্নায়ুতন্ত্রের সংগঠনের তেমন বৃদ্ধি না ঘটলেও ৪ বছরের পর এই সংগঠনের বৃদ্ধি ঘটে।
- যান্ত্রিক বিকাশ: 6-৪ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেদের ক্ষেত্রে হৃদ্যন্ত্র মেয়েদের থেকে বড়ো হয় কিন্তু ৪ বছরের পর মেয়েদের হৃদ্যন্ত্র অপেক্ষাকৃত বড়ো হয়।বাল্যকালের অন্যান্য দৈহিক বিকাশগুলি হল-
- মস্তিষ্কের বিকাশ: আকারে ও ওজনে মস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মতো হয়।
- দেহসঞ্চালনমূলক বিকাশ: এই বয়সে শিশুরা খাওয়া, নিজের জামাকাপড় পরা, দৌড়োনো, লাফানো ইত্যাদি দেহসঞ্চালনমূলক কাজ করতে পারে। দৈহিক শক্তি বাড়ে, ক্লান্তি প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে, পেশিগুলিও বিকশিত হয়।
(2) মানসিক বিকাশ ও বৌদ্ধিক বিকাশ: এই স্তরে গুরুত্বপূর্ণ মানসিক বিকাশগত বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- মনোজগৎ ও বহির্জগতের মধ্যে পৃথক্করণ: এই স্তরে বালক-বালিকারা মনোজগৎ ও বহির্বিশ্বের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে।
- প্রাকৃতিক নিয়ম সম্বন্ধে ধারণা: 11-12 বছরের বালক-বালিকাদের মধ্যে প্রাকৃতিক বিভিন্ন নিয়ম সম্বন্ধে যথাযথ ধারণা জন্মায়। এই বয়সে তারা জানার চেষ্টা করে আকাশের রং নীল কেন? সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তদের আগ্রহ দেখা যায়।
- প্রত্যক্ষণে পরিপক্বতা: এই স্তরে বালক বা বালিকাদের মধ্যে প্রত্যক্ষণে পরিপক্কতা এলেও মানসিক পরিপক্কতা যথাযথভাবে আসে না। শিশু কোনো জিনিস দ্যাখে ঠিকই, তবে তার কারণ বুঝতে পারে না। যেমন- শিশু জবা ফুল দেখল, ফুলের রং লাল কেন তা বুঝতে পারে না।
- বিভিন্ন ঘটনার প্রতি কৌতূহল: এই বয়স স্তরের বালক / বালিকা বা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন ঘটনার প্রতি কৌতূহল সৃষ্টি হয়। যেমন-ঐতিহাসিক বা প্রাকৃতিক স্থানে গেলে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে।
- চিন্তাভাবনার উৎকর্ষতা: চিন্তাভাবনার মধ্যে উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। যেমন- মুরগি ডিম পাড়ে, চড়ুই একটা পাখি ইত্যাদি। বাল্যকালের অন্যান্য মানসিক বিকাশগুলি হল-
- সামান্যীকরণ ক্ষমতা: এই স্তরে শিশুর সামান্যীকরণ ক্ষমতা বাড়তে থাকে। যেমন- যাদের পালক আছে, যারা উড়তে পারে, সেগুলি যে পাখি তা বুঝতে পারে। যে প্রাণীটি ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে, তা প্রাণীর ডাক শুনে কোন্ প্রাণী, তা বুঝতে পারে। কুকুর ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রাণীর ডাক শুনে কোন প্রাণী , তা বুঝতে পারে ।
- স্মৃতিশক্তি: এই স্তরে ছেলেমেয়েদের স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়। শিশুরা বাল্যের অভিজ্ঞতা অনেক দিন মনে রাখতে পারে।
(3) ভাষার বিকাশ : ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রেও বাল্য বয়সে যে পরিবর্তন দেখা যায়, তা হল-
- 6 বছরে বালক/বালিকারা প্রায় 2600 শব্দ শেখে কিন্তু তারা প্রায় 20,000-24,000 শব্দগ্রহণ করতে পারে।
- 11 বছর বয়সে শিক্ষার্থী 50,000 শব্দ শেখে।
(3) প্রাক্ষোভিক বিকাশ: বাল্যকালে বিভিন্ন ধরনের প্রাক্ষোভিক বিকাশ দেখা যায়। সেগুলি হল-
- প্রক্ষোভের পরিবর্তন: প্রারম্ভিক বাল্যকালে প্রাক্ষোভিক পরিবর্তন দেখা যায় কিন্তু প্রান্তীয় বাল্যকালে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রক্ষোভের অনুভূতি প্রকাশ করে। এইসময় প্রক্ষোভের দরুন মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
- আনন্দ অনুভূতি: শিক্ষার্থীরা আনন্দ অনুভূতিগুলিকে কেন্দ্র করে প্রাক্ষোভিক প্রতিক্রিয়াগুলি তীব্রভাবে প্রকাশ করে।
- আবেগের প্রকাশ: আবেগের প্রকাশ নির্দিষ্ট রূপ পায়। আবেগের প্রকাশে বস্তুর উপস্থিতি অপরিহার্য নয়। সামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেকসময় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করলেও তার বহিঃপ্রকাশ অন্য প্রক্ষোভের মাধ্যমে দেখায়।
- ভীতি: এইসময় যথাযথ ভয়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এদের মধ্যে ভয়ের ভাব দেখা যায়। বস্তু ভীতি, উচ্চস্থান ভীতি, শব্দ ভীতি অনেকটা দূর হয়। কাল্পনিক জীবের প্রতি ভয়, পড়ে যাওয়ার ভয় অনেকটা চলে যায়।
- ব্যক্তিগত অনুভূতি: বাল্যকালে ব্যক্তিগত অনুভূতি বাড়ে। যাদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের কাছ থেকে স্নেহ-ভালোবাসা প্রত্যাশা করে আবার তাদেরকেও ভালোবাসতে শেখে। বাল্যকালের অন্যান্য প্রাক্ষোভিক বিকাশগুলি হল-
- ক্রোধ: বয়স্কদের অবহেলা, সমবয়সিদের পরিহাস, কাজে বাধা, বন্ধুর সঙ্গে অন্য কোনো ব্যক্তির খারাপ আচরণ, বিভিন্ন ধরনের স্বার্থবিঘ্নকারী ঘটনা। ইত্যাদি এই বয়সের ছেলেমেয়েদের ক্রোধের কারণ হয়।
- ঈর্ষাবোধ: বাবা-মা বা গুরুজন বা শিক্ষক পক্ষপাতিত্ব করেন যা ঈর্ষার। কারণ হয়। এর ফলে তাদের প্রতি রাগ হয় এবং তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।। মেয়েদের ক্ষেত্রে ঈর্ষার ভাব বেশি দেখা যায় কারণ তাদের উপর তুলনামূলক বেশি পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হয়।
(5) সামাজিক বিকাশ: এই স্তরে সামাজিক বিকাশ বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই বয়সের সামাজিক বিকাশগুলি নিম্নরূপ-
- স্বাভাবিক জীবন: শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করে এবং আত্মকেন্দ্রিক ভাব কাটিয়ে ওঠে।
- স্বাধীন চেতনার বিকাশ: শিক্ষার্থীর স্বাধীন চেতনার বিকাশ ঘটে, এ নিজেরাই পরিবেশকে জানতে চায়।
- সামাজিক পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া: পরিবারের গন্ডির বাইরে ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়, ফলে সামাজিক পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়।
- দলবদ্ধতা: এই স্তরে ছেলেমেয়েরা দলবদ্ধভাবে খেলাধুলা করতে ভালোবাসে এবং খেলাধুলার নিয়মকানুন মেনে চলার প্রবণতা দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পালনের জন্য দলবদ্ধ হতে পারে এবং নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য দেখা যায়।
- বন্ধুত্ব: এই স্তরে সমবয়সিদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বাল্যকালের অন্যান্য সামাজিক বিকাশগুলি হল-
- নৈতিকতাবোধ: নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হলে আচরণের নৈতিক মান দলের মতামত দ্বারা নির্ধারিত হয়। তাই কোনো কোনো সময় তাদের মনে হয় উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন আবার কোনো কোনো সময় মনে হয় তাদের মধ্যে কোনো নৈতিক মূল্যবোধ নেই।
সহযোগিতার মনোভাব: এই স্তরে আত্মকেন্দ্রিকতার মনোভাব অনেকটা। দূর হয় ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে বহির্মুখী। মনোভাব দেখা যায়।