নেতাজির স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার উৎস লেখো

নেতাজির স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার উৎস লেখো

নেতাজির স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার উৎস লেখো
নেতাজির স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার উৎস লেখো

নেতাজির স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার উৎস

(1) প্রাথমিক প্রভাব

জীবনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর পিতা জানকীনাথ বসুর কাছ থেকে দেশ ও রাজনীতি সম্পর্কে শিক্ষা নিয়েছিলেন। জানকীনাথ বসু বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্কুল জীবনে তাঁর প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসের প্রভাব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। শৈশব থেকেই তাঁর জীবনে তিনি স্বদেশী আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, স্কুলে পড়াকালীন ইউরোপীয় বন্ধুদের জাতিগত ও বর্ণগত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ তাঁর মধ্যে একটু একটু করে বিপ্লবী চেতনার সঞ্চার ঘটায়।

(2) রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ধর্ম-নৈতিকতার প্রভাব

সুভাষচন্দ্রের কৈশোর জীবনে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ব্যাপক প্রভাব ছিল। অধ্যাপক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “সুভাষচন্দ্র বিবেকানন্দের দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে আমার নিজের মনে হয়েছে বিবেকানন্দের প্রভাব ছাড়া যে সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষকে দেখেছে তাঁর আত্মপ্রকাশ সম্ভব ছিল না।” নেতাজি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “Vivekananda entered my life” (বিবেকানন্দ আমার জীবনে প্রবেশ করেছিল)। সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত স্বদেশ চেতনার মূল উৎসই ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ না করে ভালোবাসার মন্ত্রে বেঁধেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাকেই বৃহত্তর ক্ষেত্রে রূপদান করেছিলেন নেতাজি। বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন ধর্ম, ভাষার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ভারতবর্ষের আত্মা এক। এই সুন্দর শিক্ষাটি নেতাজি তাঁর কাছ থেকেই নিয়েছেন।

(3) অরবিন্দ ঘোষ, হেগেলের তত্ত্ব ও বৈঘ্নব দর্শনের প্রভাব

তরুণ বয়সে সুভাষচন্দ্র ভারতীয় দর্শন অধ্যয়ন করেছিলেন। সেখানে অরবিন্দের আধ্যাত্মিক দর্শন থেকেও তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীকালে ‘ভাব’ বা ‘মায়া’ নয়, বরং পৃথিবীর বাস্তবতাকে তিনি মান্যতা দিয়েছিলেন। হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ধারণা থেকেও তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আবার বৈয়ব দর্শন অধ্যয়ন করে প্রেমের আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন।

(4) পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও নেতৃত্বকারী ভূমিকা

প্রথম জীবনে কলকাতায় পড়াশুনা, পরবর্তীকালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন তাঁকে বিভিন্ন জানা-অজানা জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে এবং জাতীয়তাবাদী আদর্শ সম্পর্কে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর জাতীয় কংগ্রেসের উল্লেখযোগ্য নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং আরও পরে আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA) গঠন করে এক জনপ্রিয় বিশ্বাসযোগ্য নেতায় পরিণত হন এবং ভারতকে বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে স্বাধীনতা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন।

(5) বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যলাড

দেশ-বিদেশের সমকালীন বহু বিশিষ্ট মনীষী তথা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্যের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের লেখায় বাংলায় জাতীয়তাবাদের যে প্রভাব ঘটেছিল তা সুভাষের নজরে আসে। তিনি বিবেকানন্দের সমাজ পরিবর্তনের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশ্ববিখ্যাত মনীষী রোমা রোলা, এইচ জি ওয়েলস, বার্ট্রান্ড রাসেল, ডি ভ্যালেরা, জে বি এস হ্যালডেন প্রমুখদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মহাত্মা গাধি, জওহরলাল নেহরু, সূর্য সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের গুরুত্ব তাঁর উপর অপরিসীম। তাঁদের মতামত নিয়ে বা কখনো তাঁদের সাথে একত্রে তিনি কাজ করেছিলেন।

(6) নেতাজির স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা

স্বাধীনতা হল স্ব-অধীনতা, অর্থাৎ অন্য কারোর ইচ্ছায় নয়, নিজের ইচ্ছার অধীনে থেকে জীবনযাপন করা হল স্বাধীনতা। একজন নাগরিকের কাছে স্বাধীনতার গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশেষত, যে দেশ পরাধীন বা যেখানে মানুষকে বিদেশি শক্তির দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে থাকতে হচ্ছে, সেখানে স্বাধীনতা হল এক মহার্ঘ বস্তু। স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, সবার জন্য সমান আইন, সমান আর্থ- সামাজিক সুযোগ, আইনের চোখে সবাই সমান।

দেশকে পরাধীনতার দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। যেখানে নেতাজির আহবান ছিল, “তোমরা আমায় রক্ত দাও, আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব।” (“Give me blood, I will give you freedom”)। তিনি ছিলেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মৃত্যুঞ্জয়ী সেনানায়ক। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা তাঁর দেশপ্রেমের গভীর অনুভূতি, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষদের প্রতি অঙ্গীকার, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।

(7) ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতায় নেতাজির ভূমিকা

স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বে নরমপন্থী নেতৃত্বগণ ব্রিটিশদের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা মূলত আবেদন-নিবেদনের পদ্ধতিতে সংস্কার সাধনের ধারণায় বিশ্বাস করতেন। নেতাজিও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিকে গান্ধিজির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগদান করেন।

  • অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান : ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ যখন গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল, তখন সুভাষচন্দ্র নীরব থাকতে না পেরে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে গান্ধিজির সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তেমন কোনো সদুত্তর পাননি। এরপর তিনি চলে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনের একান্ত শিক্ষক, প্রিয়নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কাছে। তাঁর কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল নেহরু ও শ্রীনিবাস আয়েঙ্গারের সঙ্গে ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত হন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। ঐ বছরেই তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন এবং তিনি গ্রেপ্তার হন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী এবং তীব্র করতে বিদেশি সাহায্যের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে গান্ধি-আরউইন চুক্তির বিরোধিতা করেন তিনি, কারণ গান্ধিজির আইন অমান্য আন্দোলনকে প্রত্যাহার করে  নেওয়ার সিদ্ধান্তকে তিনি মানতে পারেননি।
  • করাচিতে অধিবেশন : ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে করাচিতে অনুষ্ঠিত ‘সর্বভারতীয় নওজোয়ান কংগ্রেস’-এর অধিবেশনে সভাপতিত্বকালীন সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবরকম দাসত্ব-সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে এবং আমাদের সর্বতোভাবে এবং পূর্ণভাবে স্বাধীন হতে হবে।’
  • কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচন: এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে অবিচল থাকার কারণে কংগ্রেসের উচ্চনেতৃত্বের সঙ্গে নেতাজির যে বিরোধ দেখা দেয়, তার জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়। এক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ঘটনার আলোকপাত করা দরকার। আন্দোলনের পদ্ধতিগত দিক নিয়ে মতান্তর হওয়া সত্ত্বেও গান্ধিজি উপলব্ধি করেছিলেন সুভাষচন্দ্র একজন প্রকৃতই জনপ্রিয় তরুণ দেশপ্রেমিক। তাই তিনি নিজেই ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের নাম প্রস্তাব করেছিলেন এবং ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মিউনিখ চুক্তির পরবর্তীকালে তিনি সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় যুদ্ধের সঙ্গেই ভারতে ব্রিটিশ শক্তিকে উচ্ছেদ করার জন্য জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তিকে প্রস্তুত করা। এই সিদ্ধান্ত তাঁকে জাতীয় কংগ্রেসের গান্ধিবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত করেছিল। ফলে, বল্লভভাই প্যাটেল, ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, জে বি কৃপালনি প্রমুখ নেতৃত্ববৃন্দ সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচনের বিরোধিতা করেন। পরিবর্তে গান্ধিজির নিকটস্থ পট্টভি সিতারামাইয়াকে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নির্বাচনে জয়ী হন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে সুভাষচন্দ্র বসু ত্রিপুরী কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শক্তিকে ভারতবর্ষের মাঠ থেকে সমূলে উৎখাত করা এবং তা সফল করতে সমস্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করা উচিত বলেও তিনি মনে করতেন।
  • ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় কংগ্রেসের ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি উপদল গঠন করেন। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি শ্রমশক্তিকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তিনি বোম্বাই এ কংগ্রেসের মধ্যেকার সমাজতন্ত্রী, এম এন রায়ের র‍্যাডিকাল লিগ ও বামপন্থীদের নিয়ে একটি বাম-সংহতকরণ কমিটি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আপোসহীন সংগ্রাম করা এবং কংগ্রেসের আমূল সংস্কার করা। সুভাষচন্দ্র সারা দেশে যে ঝটিকা সফর সংঘটিত করেছিলেন, সেসময় তিনি জনগণকে আত্মত্যাগের জন্য উপযুক্ত মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে গেরিলা বাহিনী তৈরি করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। শ্রমিকদের ধীরে ধীরে সংঘটিত করে তুলেছিলেন। তিনি নারী সমাজকেও স্বাধীনতা আন্দোলনে এগিয়ে আসতে আহবান করেছিলেন। তাঁর আহবানে ভারতীয় সমাজের একটি বৃহৎ অংশের মহিলারা সশস্ত্র সংগ্রামে সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন।
  • দেশ ত্যাগ বা মহানিষ্ক্রমণের পর: ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতভূমি ত্যাগ করেন। তারপর কাবুল থেকে রাশিয়া হয়ে পৌঁছান জার্মানির রাজধানী বার্লিনে। যেখানে তিনি বন্দি প্রায় ৪০০ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে ‘ফ্রি ইন্ডিয়ান রিজিয়ান’ নামে একটি সেনাদল গঠন করেন। এখানে সুভাষচন্দ্র ‘নেতাজি’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। তারপর তিনি জাপানে পৌঁছান এবং সেখানকার প্রধানমন্ত্রী তোজো তাঁকে ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধে সবরকম সাহায্যের জন্য প্রতিশ্রুতি দেন। ইতিমধ্যে জাপান অধিকৃত সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ও ক্যাপ্টেন মোহন সিং জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসেই সুভাষচন্দ্র বসু এই বাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং তার নাম দেন আজাদ হিন্দ ফৌজ।

উক্ত বছরেই আয়ার্ল্যান্ডের বিপ্লবীদের অনুসরণ করে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। জার্মানি, ইতালি-সহ আরও ছয়টি রাষ্ট্র এই সরকারকে স্বীকৃত দেয়। জাপান সরকার তার অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ আজাদ হিন্দ সরকারকে অর্পন করে। সুভাষচন্দ্র দ্বীপগুলির নতুন নামকরণ করেন শহীদ ও স্বরাজ। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফ্রেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ ফৌজ আরাকান দখল করে, এরপর ব্রহ্মদেশ অতিক্রম করে ভারতের মাটিতে পা রাখে। রণধ্বনি ছিল, “জয় হিন্দ, দিল্লি চলো।” এই সেনাদল ভারতের প্রায় ১৫০ মাইল এলাকা ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করতে সফল হয়েছিল।

(8) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা

নেতাজি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার অর্থ কেবল রাজনৈতিক বন্ধনমুক্তি নয়, এই স্বাধীনতা সম্পদকে সমানভাবে বণ্টন করবে…।’

  • শ্রেণিবৈষম্য রোধ: সত্যিকারের একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে এই কথাটা তিনি অনুভব করেছিলেন যে, সমাজে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যে অভ্যন্তরীন সংগ্রাম চলছে তাকে দীর্ঘায়িত করা যাবে না। বরং এই সংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে শ্রেণিবৈষম্য রোধ করা দরকার।
  • প্রতিঘাত শক্তিকে প্রতিরোধ: আন্দোলনের মধ্যে থেকে এক প্রতিঘাতমূলক শক্তি গড়ে উঠেছিল, অর্থাৎ ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে কিছু জনগণ ব্রিটিশ সরকারের শিবিরে যোগদান করে। এই প্রবণতা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভের জন্য অসহ্য দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করার মতো নৈতিক শক্তি থাকা প্রয়োজন। নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ছাড়া কোনো জাতিগঠন করা যায় না।
  • সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথ: তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথেই দারিদ্র্য, কৃষি বিষয়ক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন জমিদারতন্ত্রের বিলোপসাধন, কৃষি বিষয়ক ঋণ মুকুবের জন্য গ্রামীণ গরিব কৃষকদের বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে ঋণদানের জন্য ওকালতি করেছিলেন।
  • কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি: তাঁর মতে, গ্রাম হবে সমবায়ভিত্তিক। এর মাধ্যমে সুভাষচন্দ্র বসু সমাজের শ্রমিক-মজুর শ্রেণির বেঁচে থাকার অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়া শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের উপর জোর দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের অর্থনীতিতে কৃষি এবং কৃষকের ভূমিকা সর্বাধিক। তাই তিনি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনের কথাও বলেছিলেন। ভারতীয় গ্রাম্য সমাজে যারা বসবাস করেন, তাদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্পের প্রয়োজন। এই কারণে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে কিষান সভা গঠন করেছিলেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ১০ জুন সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লকের নাগপুর অধিবেশনে কৃষকদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন নিয়েও আলোচনা করেছিলেন।
  • স্বয়ংসম্পূর্ণতা : নেতাজি ভারতকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বিদেশি শক্তির উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে ও দেশের শিল্প সম্পদগুলিকে শক্তিশালী করার উপর জোর দিয়েছিলেন।
  • শিল্পায়ন: তিনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং ভারতের অর্থনীতির আধুনিকীকরণের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন।
  • অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: তিনি চেয়েছিলেন ভারতের অর্থনৈতিক সম্পদ এবং শিল্পের উপর ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ অবসান ঘটিয়ে সমস্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলির জাতীয়করণ করা।
  • অর্থনৈতিক সমভা: নেতাজি সম্পদের বৈষম্য এবং সুবিধাবঞ্চিতদের উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির সুষ্ঠু বণ্টনের কথাও বলেছিলেন।

(9) সামাজিক স্বাধীনতা

নেতাজি সামাজিক স্বাধীনতার দৃষ্টিভঙ্গিটির যেসমস্ত দিকগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সেগুলি হল-

  • প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতার ধারণা সমস্ত ধরনের বৈষম্য ও শোষণ থেকে মুক্ত এবং সামাজিক সমতাকে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষপাতী ছিলেন। এজন্য নেতাজি সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, দলিত শ্রেণি, মহিলা ও অন্যান্য দুর্বল শ্রেণির মানুষদের স্বপক্ষে স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনে করতেন যতদিন না পর্যন্ত ভারতে ধনী, দরিদ্র, জাতি, ধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবে না। তিনি প্রান্তিক সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য জাতীয় উন্নয়নে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সামাজিক সংস্কার ও শিক্ষার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়নের কথা বলেছিলেন।
  • মহিলাদের অধিকার: নেতাজি মহিলাদের অগ্রগতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকেও সমর্থন করেছিলেন। তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীকে যে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঝাঁসি ব্রিগেড। এটি মূলত ছিল নারী বাহিনী। এই বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ড. লক্ষ্মী স্বামীনাথন।
  • জাতীয় ঐক্য: নেতাজির কাছে সামাজিক স্বাধীনতা ছিল জাতীয় ঐক্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তার মতে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক বিভাজন কাটিয়ে একটি সুসংহত ও শক্তিশালী জাতি গঠনের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব।
  • সাম্য ও ন্যায় বিচার: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তরুণ বয়স থেকে স্বামী বিবেকানন্দের ‘স্বাধীনতার, বাণীর’ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। আবার শ্রী অরবিন্দের বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা- ‘আমরা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত পূর্ণ স্বরাজ চাই’-এর মাধ্যমে তাঁর মনে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রতিফলন হয়েছিল। ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা, শৃঙ্খলা এবং প্রেম হল ভারতীয় সমাজের প্রধান ভিত্তি। নেতাজি বর্ণ ও শ্রেণিবৈষম্য দূর করার পক্ষে ছিলেন। তিনি এমন একটি সামজের কল্পনা করেছিলেন যেখানে সমস্ত ব্যক্তি সমান সুযোগ ভোগ করবে।
  • অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা অর্জন: ‘The Indian Struggle’ নামক গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে মানবসভ্যতার ইতিহাস তার নিজের পথেই এগোবে। রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সামাজিক সংগ্রাম একই সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে। যে দল রাজনৈতিক স্বাধীনতা আদায় করবে, সেই দলই দেশবাসীর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা অর্জনের দায়িত্ব নেবে।

(10) জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতার অবসান ও ধর্মীয় স্বাধীনতা 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিশ্বাস ছিল প্রকৃত স্বাধীনতা দেশের মধ্যে জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় অসহিষুতার পরিসমাপ্তি ঘটাতে সাহায্য করে।

  • বিভাজন ও শাসন নীতির বিরোধিতা: ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জন্য সাম্প্রদায়িক ভাগ বাঁটোয়ারার ভিত্তিতে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, নেতাজি তার তীব্র বিরোধিতা করেন। নেতাজি বুঝতে পেরেছিলেন, শ্বেতপত্রের মূল উদ্দেশ্য হল ভারতকে আরও খন্ডিত করা, ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা। ব্রিটিশদের এই ‘Divide and Rule’ (বিভাজন ও শাসন) নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন সুভাষচন্দ্র। দেশের বাইরে গিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এই বাহিনীতে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তিকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লকের সমাজতান্ত্রিক ছাঁচে গৃহীত কর্মসূচিতে সুভাষচন্দ্র বলেন যে, দেশের সকল জনসম্প্রদায়ের মধ্যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন। এজন্য প্রত্যেকটি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
  • সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধ: ভারতবাসীকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠার আহবান জানিয়ে নেতাজি বলেন- “আমাদের কেবল নিজেদের অতীতের দিকে তাকাতে হবে এবং ঐতিহাসিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। এর মধ্যে হিন্দু বা মুসলিমের কোনো ব্যাপার নেই। এটা বহু সংস্কৃতির মিলনের ফল।”
  • ধর্ম থেকে রাজনীতির পৃথক্করণ: তিনি চেয়েছিলেন ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করতে। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা সুভাষচন্দ্র শুধু বলেননি, সেই কথাকে কাজেও পরিণত করেছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাসের ‘Bengal Pact’-এ তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল। এই ‘প্যাক্ট’ চেয়েছিল বঙ্গীয় বিধান পরিষদে প্রতিনিধিদের ভিত্তি হবে জনসংখ্যা। তবে যতদিন না মুসলিমদের যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব থাকছে ততদিন তাদের বিশেষ সংরক্ষণ দেওয়া হবে। এমনকি তিনি বলেছিলেন রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ও উর্দুর সংমিশ্রণে ‘হিন্দোস্তানি’ হওয়া দরকার। তিনি সবসময়ই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। তাঁর মত অনুযায়ী, ধর্মীয় পার্থক্যের ভিত্তিতে ভারতীয়দের বিভক্ত করা উচিত নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সর্বধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যার ফলে ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করা সম্ভবপর হবে।
  • বাস্তব প্রয়োগ: সুভাষচন্দ্র যে একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আজাদ হিন্দ ফৌজের (INA) যুদ্ধক্ষেত্রে এক নৈশভোজনসভার বিবরণ থেকে। সেই নৈশভোজের সভায় তিনি হিন্দু এবং মুসলিম সৈন্যদের একত্রে নিয়ে ভোজনপর্ব সেরেছিলেন। এই থেকে বোঝা যায়, ধর্মীয় বিষয়ে সুভাষের প্রচেষ্টা বিস্ময়কর। তিনি কোনোরকম ধর্মীয়, জাতিগত, লিঙ্গগত বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেননি।

(11) স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথ

  • সশস্ত্র সংগ্রাম: কংগ্রেসের অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের নীতি ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য যথেষ্ট ছিল না এটা নেতাজি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি স্বাধীনতার জন্য শেষপর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এভাবে তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করে তোলার জন্য বিদেশের মাটিতে স্বাধীন ভারত সরকার গড়ে তোলেন এবং শত্রু ইংরেজ সরকারকে নোটিশ দিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট তিনি ঘোষণা করেছিলেন ‘স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার। পৃথিবীতে আজ আর এমন কোনো শক্তি নেই যে সেই অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে পারে।’
  • কঠোর  আত্মত্যাগ: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ব্রিটিশরা ১১ বার কারারুদ্ধ করেছিল। তবু তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি থেকে সরে আসেননি। স্বাধীনতার জন্য তাঁর আত্মত্যাগ, আত্মবলিদানের কোনো তুলনা হয় না। নেতাজি জানতেন স্বাধীনতার পথ সহজ নয়। তাঁর কাছে স্বাধীনতা ছিল এক আদর্শ, তাঁর কাছে স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল তাঁর নিজ বিবেকের আহবান। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার জন্য কোনো রাজপথ নেই, এ হল কণ্টকময় পথ, তবু এ পথ গৌরবের দিকে অমরত্বের দিকে চালিত করে’ (‘there is no royal road to freedom… a thorny one, but it is a path which also leads to glory and immortality.’)।

(12) পূর্ণ স্বরাজ প্রতিষ্ঠা

সুভাষচন্দ্রের আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল Militant Nationalism। অহিংসার পরিবর্তে সশস্ত্র বৈপ্লবিক প্রতিরোধ চেয়েছিলেন তিনি এবং পূর্ণ স্বাধীনতা (পূর্ণ স্বরাজ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর পূর্ণ স্বরাজ ধারণাটি যেই সমস্ত দিকগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করে সেগুলি হল-

  • সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব: নেতাজি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে এবং সম্পূর্ণ ও নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা প্রদান করতে।
  • সহিংস পদ্ধতি: তিনি ভারতকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ধারণাটিকে সমর্থন করেছিলেন। যেই উদ্দেশ্যে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA) এবং আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেছিলেন।
  • একতা: তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মূল্যায়ন

(1) সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতার ধারণাটি ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার ধারণার মধ্যে নিহিত ছিল। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি আক্রমণাত্মক ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপে বিশ্বাস করতেন।

(2) জাতীয় ঐক্যসাধন

নেতাজি স্বাধীনতার অন্বেষণে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে এবং ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বিভেদ অতিক্রম করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার প্রমাণ তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের (INA) সেনাবাহিনীতে দেখিয়েছিলেন। সৈন্যদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে উঠেছিল।

(3) আন্তর্জাতিক সমর্থন

নেতাজি ঔপনিবেশিকতার ও সাম্রাজ্যবাদের বৈশ্বিক গতিশীলতাকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন চেয়েছিলেন। জাপান ও জার্মানির মতো দেশগুলি থেকে সাহায্য সংগ্রহের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে।

(4) প্রতিরোধের উত্তরাধিকার

নেতাজির স্বাধীনতার ধারণা জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। সবথেকে বড়ো কথা ভারতের হীন দরিদ্র অত্যাচারিত জনগণ যাতে সাহসের সঙ্গে তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে পারে, তার জন্য নেতাজির শিক্ষা অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তাই বর্তমান বিশ্বে স্বাধীনতা এবং অধিকার সম্পর্কিত যে- কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে নেতাজির চিন্তাধারা আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।

সামগ্রিকভাবে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতার ধারণাটি ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে মধ্যে কৌশল এবং মতাদর্শের বৈচিত্র্যের একটি প্রমাণ হিসেবে অনুরণিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন – গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দাও

Leave a Comment