স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার আলোচনা করো

স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কারসমূহ
সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা স্বামীজি সরাসরি কখনো উল্লেখ করেননি। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবর্ষকে কালিমালিপ্ত করেছে পাশ্চাত্য রাজনৈতিক শক্তি। তিনি কখনো প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি। ব্যক্তির মধ্যে আধ্যাত্মিকতাবোধকে জাগ্রত করতে তিনি সন্ন্যাসী বেশ ধারণ করেন। এটিকেই তিনি সঠিক পন্থা বলে মনে করতেন। তবে তিনি পরোক্ষ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক অধিকারের দাবিকে সমর্থন করতেন। তাঁর মতে, জাতীয় চরিত্র গঠনের মূল উপাদান হল শক্তি বা ক্ষমতা, যার সাধনা একমাত্র বৈদান্তিক দর্শন চর্চার পরিপ্রেক্ষিতেই করা সম্ভব। এককথায় তিনি বৈদান্তিক দর্শন চর্চার মাধ্যমেই দেশবাসীকে জাতীয় চেতনাতে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন।
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর বিবেকানন্দ প্যারিস থেকে আলাসিঙ্গাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি কোনো প্রকার রাজনীতিতে (Politics) বিশ্বাসী নই। ঈশ্বর ও সত্যই জগতে একমাত্র রাজনীতি, আর সব বাজে।’ এ ছিল বাস্তবিকভাবেই স্বামীজির নিজের অন্তরের কথা। তিনি রাজনীতির সংকীর্ণ আবর্ত থেকে বহু ঊর্ধ্বে, বহু দূরে ছিলেন। উপরোক্ত চিঠিতে স্বামীজি একথাও লিখেছিলেন, ‘আমি যেমন ভারতের, তেমন সমগ্র জগতের।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতবাসীর ‘বিশেষ দাবি’ স্বামী বিবেকানন্দের উপরে আজও অম্লান। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে, ভারতের জনজাগরণে স্বামীজির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও রাজনৈতিক সংস্কারের তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনেকখানি।
এ প্রসঙ্গে ডেনিস ডালটন লিখেছেন, রাজনীতি ও ক্ষমতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ-র শিক্ষা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সমাজ সংস্কারের পথ ধরেই রাজনৈতিক সংস্কারে বিবেকানন্দ অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সামাজিক সংস্কার, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, জাতীয়তাবাদের একটি আধ্যাত্মিক ভিত্তিস্থাপন-এগুলির মধ্যে দিয়েই স্বামীজি রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান রেখেছিলেন।
তাঁর দৃষ্টিতে ব্যক্তি ও সমাজ ছিল রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে। কারণ তাঁর কাছে রাষ্ট্র হল লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় মাত্র। এজন্য সংসদীয় গণতন্ত্রের তীব্র নিন্দা করে বিবেকানন্দ বলেন, “পারলেমেন্ট দেখলুম, সেনেট দেখলুম, ভোট ব্যালট মেজরিটি সব দেখলুম… শক্তিমান পুরুষরা যেদিকে ইচ্ছে সমাজকে চালাচ্ছে বাকিগুলি ভেড়ার দল।” (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য)। স্বামীজি কোনো রাষ্ট্র দার্শনিক বা রাজনীতিবিদ ছিলেন না। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষভাবে সংযোগও ছিল না। এ প্রসঙ্গে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘Discovery of India’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “He (Vivekananda) kept away from politics and disapproved of politicians of his days.”।
স্বামীজির চিন্তা ও চেতনা, ভাবাদর্শ দেশের জনসাধারণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিল। ভারতবর্ষ তথা বাংলার পটভূমিতে অনেকে বিবেকানন্দকে জাতীয়তাবাদের জনক হিসেবে অভিহিত করতে চেয়েছিলেন। তারা মনে করতেন, স্বামীজির জাতীয়তাবাদী ভাবধারার দুটি উৎস রয়েছে। একটি হল, জাতীয় সংকট এবং অপরটি হল, ব্যক্তির সহজাত সম্প্রীতির প্রবৃত্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষই একমাত্র জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করতে সক্ষম। আর এই চেতনাকে জাগ্রত করতে স্বামীজি মানুষের বৈষয়িক উন্নতির উপর গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। যদিও তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন – না, কিন্তু তাঁর ধারণা এবং শিক্ষা ভারতের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
তাঁর রাজনৈতিক সংস্কারগুলি মূলত জাতির পুনর্জন্ম, শিক্ষার বিকাশ, সামাজিক উন্নয়ন এবং জনগণের ক্ষমতায়নের উপর জোর দিয়ে থাকে। এমনকি বর্তমান ভারত ও আগামী ভারতকে দিশা দেখানোর জন্যও তা সমান প্রাসঙ্গিক। স্বামীজির রাজনৈতিক সংস্কারের প্রধান দিকগুলি হল-
(1) জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার
বিবেকানন্দ ব্রিটিশ ভারতের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ না নিলেও তিনি স্বাধীনতার একজন সমর্থক ছিলেন। ব্রিটিশদের অপশাসনকে তিনি কখনোই মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর রচিত ‘জ্ঞান যোগ’, ‘রাজ যোগ’, ‘বর্তমান ভারত’, ‘পরিব্রাজক’ প্রভৃতি গ্রন্থ এবং পত্রাবলি ভারতীয় বিপ্লবীদের জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রেরণার একমাত্র উৎস ছিল। স্বামীজি পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য বেদান্তের নতুন ব্যাখ্যা দেন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে বিশেষ উদ্যোগী হন। রাষ্ট্র তথা রাজনীতি বিষয়ক স্বামীজির ভাবনা সম্পূর্ণরূপে উদারনৈতিক সংস্কারবাহী ভাবধারার বিপরীত ছিল। উদারপন্থীদের মতো স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে তিনি অধিক গুরুত্ব না দিয়ে সামাজিক বিপ্লব তথা ভাব বিপ্লবকে বড়ো করে দেখেছিলেন।
জাতপাতের বিভেদ ছেড়ে ভারতকে তিনি ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য ও সংহতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদ জাগ্রতকরণে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ফরাসি দার্শনিক রেনাঁ (Renan)-র মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক অনুভূতি, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির মধ্যে দিয়ে। এক্ষেত্রে তিনি ভারতের যুবসমাজকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে আহবান জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বিপিনচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র ও অরবিন্দ- এর সঙ্গে তাঁর ধারণাগত সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। বিবেকানন্দের ছাত্রাবস্থায় ভারতের মুক্তি আন্দোলন ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে।
ব্রাহ্ম সমাজের মাধ্যমে তিনি রামমোহনের বৈদান্তিক আদর্শ, স্বদেশ প্রেম ও ধর্মীয় ঐক্যের আদর্শ ইত্যাদির দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। পরবর্তীকালে সন্ন্যাসী হয়েও মানবশক্তি ও আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গঠনের জন্য বিবেকানন্দ পরমজ্ঞানের মার্গকে প্রাধান্য দেন। তিনি মনে করতেন, এই অধীনতা থেকে ভারতবাসীর মুক্তির একমাত্র পথ হল সংহতির আদর্শে শক্তিমান এক জাতিগঠন। তবে তাঁর কাছে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার প্রধান শর্ত ছিল ধর্মীয় ঐক্য স্থাপন। জাতীয়তাবাদকে গুরুত্ব দিলেও, তিনি ছিলেন বিশ্বমানবতা তথা বিশ্বজনীনতার পূজারি। জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি জাতীয় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারেও ডাক দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। তিনি মনে করতেন, জাতি হিসেবে ভারতীয়দের সুমহান গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে, তাকে জানতে হবে। জাতির এই অতীত গৌরবগাঁথার সঙ্গে পরিচয় ঘটলে ভারতীয়রা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে। ভারতবাসী হিসাবে এই গর্ববোধ সবাইকে একতাবদ্ধ হতে সাহায্য করবে।
এজন্যই স্বামীজি আহবান জানিয়েছিলেন, ‘বল মূর্খ ভারতবাসী, দীন দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী আমার ভাই।….. ভারতের মৃত্তিকা আমার সর্বোচ্চ স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।’ বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের মহাসভায় অংশগ্রহণ ও বক্তৃতাদানের মধ্য দিয়ে স্বামীজি ভারত, ভারতীয় ঐতিহ্য, ধর্ম ও কৃষ্টিকে বিশ্ববাসীর নিকট ছড়িয়ে দিতে বা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনের একজন অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতের পুনরুত্থানের জন্য জাতীয় ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই তাগিদেই ভারতবাসীকে জাতি, ধর্ম ও আঞ্চলিক বিভেদ থেকে দূরে থাকতে হবে। তিনি মূলত রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বক্তৃতা, বাণী ও লেখনীগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করা।
(2) জাতীয় পুনরুজ্জীবন
বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবর্ষের জাতীয় পুনরুজ্জীবনের জন্য আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটানো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তিনি ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য ও উদ্দেশ্যবোধকে জাগ্রত করার জন্য ভারতের সমৃদ্ধশালী সাংস্কৃতিক অতীতের প্রতি দেশবাসীকে গর্বিত হতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি ভারতের প্রাচীন আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে সমর্থন করেছিলেন, যাকে তিনি ভারতের মহত্বের ভিত্তি হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন প্রতিটি জাতিরই নিজ নিজ সত্তা বর্তমান, যেগুলি একটি জাতীয় জীবনের অন্যান্য বিষয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে জার্মান দার্শনিক হেগেল-এর চিন্তাধারার সঙ্গে স্বামীজির ভাবনার সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ভারতের জাতীয় জীবনের প্রধান নির্ধারক হল ধর্ম। তাঁর কাছে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার অর্থ ছিল ভারতের শাশ্বত আদর্শকে অনুধাবন ও অনুসরণ করা। জাতির ভবিষ্যতকে গৌরবান্বিত করে তুলতে অতীত ঐতিহ্য ও গরিমার আশ্রয় নেওয়াকেই তিনি শ্রেয় বলে মনে করতেন।
(3) জনজাগরণের বাণী
ভারতের জনজাগরণের জন্য যেসব অগ্নিদীপ্তবাণী পরাধীন ভারতে নির্ভীক কন্ঠে বিবেকানন্দ উচ্চারণ করেছিলেন, তা জনমানসে এক ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তখনও সে অর্থে কোনো ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব আন্দোলন সংঘটিত হয়নি, তখনও দেখা যায়নি কোনো জনজাগরণ। স্বামীজি এমন একটি অবস্থায় যুবকদের উদ্দীপ্ত করতে ঘোষণা করেন, ‘ওঠো, জাগো এবং যতক্ষণ না লক্ষ্যে পৌছাঁতে পারছো থেমো না।’ (‘Arise, awake and stop not till the goal is reached.’)। বিবেকানন্দের বাণী শুধু তত্ত্ব সর্বস্ব ছিল না। তিনি তাঁর বাণীতে দৈনন্দিন জীবনে আধ্যাত্মিক নীতির প্রয়োগের উপরও জোর দিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় জনগণকে তাঁর বাণী প্রচারের মাধ্যমে তা অনুশীলন করতে এবং সততা, সমবেদনা ও সেবার জীবনযাপন করতে উৎসাহিত করেছিলেন।
এমনকি বিবেকানন্দ তাঁর বাণীর মাধ্যমে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর বাণীতে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস বজায় রেখে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা ও বৈজ্ঞানিক ভাবনা প্রচার করেছিলেন। ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত-এর মতে, স্বামীজির এই অগ্নিগর্ভ বাণী শোনার পরেই জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল (‘All the militant nationalist movement… were lunched after Swamiji’s thundering roar, arise, awake’) । স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন, নারীর উন্নতি ব্যতীত সমাজ ও জাতির উন্নতি সম্ভব নয়।
তাঁর সমকালীন নারীজাতির দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি ব্যথিত হন। সেই জন্য তিনি নারী জাতির উদ্দেশ্যে বাণী প্রচার করে বলেছিলেন, “নারীগণকে এমন যোগ্যতা অর্জন করাইতে হইবে, যাহাতে তাহারা নিজেদের সমস্যা নিজেদের ভেবে মীমাংসা করিয়া লইতে পারে। তাহাদের হইয়া অপর কেহ এ কার্য করিতে পারে না, করিবার চেষ্টা করাও উচিত নহে। আর জগতের অন্যান্য দেশের মেয়েদের মতো আমাদের মেয়েরাও এ যোগ্যতা লাভে সমর্থ।”
স্বামীজি দেশের সাধারণ মানুষকে নির্ভয় ও নির্ভীক করার জন্য তাঁর দৃঢ় বাণী শুনিয়েছিলেন। তাঁর আদর্শ ছিল বৈদান্তিক আদর্শ, যার ভিত্তিতে তিনি তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবধারা গড়ে তোলেন। তাছাড়াও তিনি ভারতবাসীর আত্মমর্যাদাকে জাগ্রত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি সমগ্র দেশবাসীর ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামকে উজ্জীবিত করতে শক্তির সাধনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। আর তাঁর কাছে পরমসত্তার অংশ হিসেবে আত্মাই হল সকল শক্তির আধার।
(4) আরাধ্য দেবতা ভারতমাতা
বন্দেমাতরমের উদ্দ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বিবেকানন্দও ভারতবর্ষকে দেশমাতৃকারূপে কল্পনা করার কথা বলেছিলেন। স্বামীজি ভারতের আরাধ্য দেবতা ভারতমাতাকে সবার উপরে তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনে করতেন, আমাদের দেশকে যদি আমরা নিজের মাতৃরূপে ভক্তি ও সেবা করি তাহলে এই দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে। বিবেকানন্দের কাছে ভারতমাতার চিত্রটি ছিল ঐশ্বরিক এবং ঐক্যবদ্ধতার প্রতীক যা ভারতীয় জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। যার লক্ষ্যই হল ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম, আধ্যাত্মিক শ্রদ্ধা ও ঐক্যবোধ জাগিয়ে তোলা।
তিনি চেয়েছিলেন এই ধারণার বিকাশের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে একটি সংস্কারমূলক এবং লালনশীল অনুভূতি জাগ্রত করতে, যা তাদের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে। স্বামীজি, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বৎসর আমাদের গরীয়সী ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা হউন, অন্যান্য অকেজো দেবতাকে এই কয়েক বৎসর ভুলিলে কোনো ক্ষতি নাই। অন্যান্য দেবতারা ঘুমাইতেছেন; তোমার স্বজাতির এই দেবতাই একমাত্র জাগ্রত।
(5) আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন
স্বামীজি স্বপ্ন দেখতেন এক আদর্শ রাষ্ট্রের। এই আদর্শ রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি ও শূদ্রের সমতার আদর্শ সবগুলিই ঠিকঠাক বজায় থাকবে অথচ এদের দোষগুলি থাকবে না। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবনা তার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিশ্বাসের গভীরে নিহিত ছিল। তিনি এমন একটি সমাজের কল্পনা করেছিলেন যা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সমাজের অগ্রগতি ঘটায়। তার আদর্শ রাষ্ট্রের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথা-
- ঐশ্বরিক নীতি: বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন যে, আদর্শ রাষ্ট্র আধ্যাত্মিক নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে। যেখানে নেতারা ও নাগরিকরা উচ্চতর নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হবেন।
- অভ্যন্তরীণ বিকাশ: তিনি আধ্যাত্মিক বিকাশ ও অভ্যন্তরীণ দেবত্বের উপলব্ধির উপর জোর দিয়েছিলেন, যা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণ ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব: তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র ধর্ম, বর্ণ ও বিভাজন অতিক্রম করে এক বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক ঐক্যে উন্নীত হবে বলে তিনি আশা করতেন।
- শিক্ষা: বিবেকানন্দের মতে, আদর্শ রাষ্ট্র এমন এক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে যা বুদ্ধি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির অর্থনৈতিক বিকাশকে সুনিশ্চিত করবে।
(6) আপামর জনগণের সার্বিক উন্নয়ন
দেশের দরিদ্র, নিপীড়িত আপামর জনসাধারণের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। তিনি দীন-দুঃখী ভারতবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর কাছে হতাশাগ্রস্ত, দুর্দশাময়, হতদরিদ্র দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ছিল অলীক স্বপ্ন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশবাসীর সার্বিক উন্নয়ন ব্যতিরেকে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা কখনোই সম্ভব নয়। তিনি স্পষ্টতই একথা বলেন যে, জাতি হিসেবে আমরা আমাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলেছি। আর তা-ই হল আমাদের যাবতীয় দুর্দশার উৎস। ভারত ও ভারতবাসীকে তার স্বাতন্ত্র্য পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবেই সকল দেশবাসীর উন্নতি সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
স্বামীজি এটা বুঝেয়েছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মূল কাজ হল আপামর জনগণের সার্বিক উন্নয়ন। যতদিন তা করা সম্ভব হচ্ছে না ততদিন দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হতে পারে না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় এই বাস্তব সত্যের কথা ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘যতদিন না ভারতের অনঅভিজাত জনসমাজ সমাদৃত হইতেছে, যতদিন না তাহাদের জন্য উপযুক্ত খাদ্য, শিক্ষা প্রভৃতির ব্যবস্থা হইতেছে, ততদিন আমাদের যাবতীয় রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিষ্ফল হইবে, এ দেশের উন্নতি সম্ভব হইবে না।’
(7) জনসাধারণের ক্ষমতায়ন
বিবেকানন্দ দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের ক্ষমতায়নের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন উদার ভারত গঠনের জন্য সামাজিক সংস্কারের পাশপাশি রাজনৈতিক সংস্কারও প্রয়োজন। তিনি শিক্ষিত অভিজাতদের জনসাধারণের সেবায় নিজেদের নিবেদিত করার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবিচার, অসাম্য দূর করার আহবান জানান।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে, জনগণের ক্ষমতায়ন সামাজিক অগ্রগতি ও শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই তিনি এমন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন যা মন এবং আত্মার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও তিনি নারীদের শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কথা বলেছিলেন, যা ব্যক্তির ক্ষমতায়নে সাহায্য করে।
(8) রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব
বিবেকানন্দ কখনোই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু তিনি নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির আধারে রাজনীতিকে পরিচালনা করায় বিশ্বাসী ছিলেন, যা হবে ধর্মনিরপেক্ষ। তিনি ধর্মকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক রূপান্তর অর্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে করুণা, নিঃস্বার্থতা এবং সেবার আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলিকে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও নীতির সঙ্গে সংযুক্ত করা উচিত। জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে ধর্মের ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “আধ্যাত্মিকতা বা ধর্ম বলতে শ্বাশত আদর্শের অনুধাবন ও অনুসরণকে বোঝায়।” তবে এক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত প্রথা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন।
(9) আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ
বিবেকানন্দের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তার আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে আধ্যাত্মিক, ঐশ্বরিক সম্ভাবনার উপলব্ধিকে জাগ্রত করা। তিনি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন যা মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং প্রতিটি ব্যক্তির আধ্যাত্মিক মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দেয়। বিবেকানন্দ সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন ধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করবে, যা সামাজিক ভেদাভেদকে দূর করতে সাহায্য করবে।
মূল্যায়ন
যদিও স্বামীজি প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু তার ধ্যানধারণা এবং শিক্ষা ভারতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছিল। শিক্ষা, সামাজিক উত্থান এবং আধ্যাত্মিক জাগরণের মাধ্যমে জাতীয় পুনরুজ্জীবনে তার দৃষ্টিভঙ্গি একটি ন্যায়সংগত, নীতিবোধ সম্বলিত, অখণ্ড ভারত গড়ার প্রচেষ্টাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন এবং সেইমতো নির্দেশনা দান করেছিলেন। ভারতবর্ষ ও ভারতবাসীর প্রতি স্বামী বিবেকানন্দের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ছিল বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তিনি স্বদেশ ও স্বজনকে বড়ো করে দেখতেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনও রকম জাত্যাভিমান ছিল না। অপর জাতিকে ছোট বা হেয় প্রতিপন্ন করার হীন মানসিকতার ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন। – তাঁর জীবন স্বল্পস্থায়ী হলেও তাঁর চিন্তাভাবনা ও কর্মকান্ড ছিল অত্যন্ত প্রসারিত।
আরও পড়ুন – গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দাও
Very good notes but too large
Thank You.