জনশিক্ষার বিস্তারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা করো

জনশিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
একটি জাতি ও একটি দেশের উন্নতির জন্য জনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বিদ্যাসাগর বলেন। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেককে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন। বাংলার কোম্পানি সরকার 1853 সালে এই প্রদেশের জনশিক্ষার প্রসারের জন্য একটি পরিকল্পনা রচনা করতে শিক্ষা পরিষদকে নির্দেশ দেন। আর তাদের পরিকল্পনা রচনায় বিদ্যাসাগর সাহায্য করেন । জনশিক্ষায় তাঁর অবদান হল
(1) বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা: দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য বাংলা ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথা বলেন বিদ্যাসাগর। অর্থাৎ তিনি মাতৃভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরার কথা বলেছিলেন।
(2) বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: বিদ্যাসাগর প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে গ্রামে গ্রামে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু তাই নয় কিছু মডেল স্কুল এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক তৈরির জন্য নর্ম্যাল স্কুল গড়ে তোলার কথাও বলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে 1850 সালে শিক্ষক প্রশিক্ষণের একটি ন্যাল স্কুল গঠিত হয়। তিনি সরকারি সহায়তায় হুগলি, নদিয়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর জেলায় 20 টি আদর্শ বিদ্যালয় গঠন করেন। তিনি নিজের গ্রাম বীরসিংহে একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন এবং সেই বিদ্যালয়ের আর্থিক দায়দায়িত্ব নিজেই বহন করেন।
(3) পাঠক্রম: বিদ্যাসাগর জনশিক্ষার উন্নয়নের জন্য পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেন ইতিহাস, ভূগোল, জীবনচরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ভৌতবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়। তিনি তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিবিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলিতে একজন প্রধান পণ্ডিত এবং দুজন সরকারি পণ্ডিতদের মাধ্যমে শিক্ষাদান করার ব্যবস্থা করেছিলেন। 1855 সালে তিনি রচনা করেন বর্ণপরিচয়ের দুটি ভাগ। এই পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি সহজ সরল এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
(4) নারীশিক্ষার প্রসার: গণশিক্ষার বিস্তারের একটি দিক হিসেবে তিনি নারীশিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দেন। মেয়েদের শিক্ষার জন্য তিনি মোট 35টি বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। নারীশিক্ষা ভাণ্ডার গড়ে তোলেন। দূরত্ব বা অন্য কোনো কারণে যাদের বিদ্যালয়ে আসা সম্ভব ছিল না তাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য গাড়ি বা পালকির ব্যবস্থা করার কথা বলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে মেকলের (Macaulay) চুঁইয়ে পড়া নীতির (Down word filtration theory) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তিনি।
(5) বয়স্ক শিক্ষার বিস্তার : জনশিক্ষার প্রসার হিসেবে বয়স্ক শিক্ষার বিস্তারেও বিদ্যাসাগরের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষ যারা বিভিন্ন কারণে প্রথাগত শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হত, সেই সমস্ত মানুষদের কথা ভেবে তিনি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর পরবর্তীকালে সাঁওতালদের জন্য তিনি সাধ্যস্কুল স্থাপন করেন। বর্তমানে যে-সমস্ত প্রথাবহির্ভূত শিক্ষাব্যবস্থা আছে সেগুলি বিদ্যাসাগরের এই সমস্ত প্রচেষ্টারই পুনঃপ্রবর্তন বলা যায়।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর