ভারতে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রকৃতি
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা কোনো তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থাকে জোর করে চাপানোর চেষ্টা চলছিল। শিক্ষাকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া ও জাতীয় চেতনা সঞ্চারের জন্য এই আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সমসাময়িক প্রতিনিধিগণ অনুভব করেছিলেন। দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা স্থিতিশীল বা প্রগতিশীল যা-ই থাকুক না কেন, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা সফল করে তুলতে হলে এই ভিত্তির উপরই তাকে স্থাপন করতে হবে। সমসাময়িক কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারকদের লেখায় ও ভাবনায় জাতীয় শিক্ষার প্রকৃতি পরিস্ফুট হয়েছে, যথা-
(1) আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে সমসাময়িক প্রতিনিধিবৃন্দ জাতীয় সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তাই তাঁরা জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে জাতীয় সংস্কৃতি যাতে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে সেদিকে দৃষ্টি রেখে শিক্ষার লক্ষ্য, প্রকৃতি স্থির করার চেষ্টা করেন।
(2) জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের একটি বিশেষ প্রকৃতি হল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে করতে হবে, যাতে ভারতবাসী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।
(3) এই আন্দোলনের অন্যতম স্বরূপ হল ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে মাতৃভাষা হবে সকল স্তরের শিক্ষার মাধ্যম।
(4) জাতীয় বিদ্যালয়গুলির পাঠক্রমে থাকবে জাতীয় ইতিহাস, রাজনীতি, জাতীয় শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্য, কারিগরি ও বৃত্তিশিক্ষা প্রভৃতি।
(5) এই আন্দোলনের অন্যতম স্বরূপ হল- পুঁথিগত, একমুখী সাহিত্য ঘেঁষা শিক্ষার পরিবর্তে শিক্ষা হবে জীবন ও সমাজের প্রয়োজনভিত্তিক।
(6) জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে উচ্চ ও নীচ সকলের জন্য জাতীয় শিক্ষার দ্বার সমানভাবে উন্মুক্ত থাকবে।
(7) জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ হবেন ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত ও দেশপ্রেম জাগ্রত। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। তাঁরা ছাত্রদের কাছে ভারতের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরবেন।
(৪) জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম স্বরূপ হল- ভারতবাসী যেন এই শিক্ষার মাধ্যমে মনে-প্রাণে ভারতীয় হয়ে ওঠে জাতির প্রতি সেবামূলক মনোভাব গড়ে তুলতে পারে। আদর্শ জাতি গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে।
বৈশিষ্ট্য
(1) জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য:
(1) আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে নেতৃবর্গের মধ্যে আদর্শগত স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল।
(2) আন্দোলন প্রধানত বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ ছিল।
(3) জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করে সম্পূর্ণ ভারতীয় কর্তৃত্ব স্থাপন করা।
(4) শিক্ষা আন্দোলনের নেতৃবর্গ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও বৃত্তিগত শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
(5) প্রথম পর্যায়ের আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের উপর নির্ভরশীল ছিল।
(6) প্রথম পর্যায়ের আন্দোলনে আবেগ ও ভাবাবেগ ছিল বেশি।
(7) প্রথম পর্যায়ে কেবলমাত্র হিন্দু সংস্কৃতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাই মুসলিমরা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি।
(৪) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠক্রমের মধ্যে কোনো বৈচিত্র্য ছিল না।
(2) দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য:
(1) দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন ছিল অপেক্ষাকৃত গভীর, ব্যাপক এবং সর্বভারতীয়।
(2) এই আন্দোলন ছিল যুক্তিনির্ভর ও সুপরিকল্পিত।
(3) হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতা এবং শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
(4) এই পর্যায়ের আন্দোলন ছিল সারা ভারতব্যাপী।
(5) প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির পাঠক্রমের নিজস্বতা ছিল।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর