জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা স্থাপনে, জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো

জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা স্থাপনে, জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো

জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা স্থাপনে, জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো
জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা স্থাপনে, জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠা

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিদেশি সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে সম্পূর্ণভাবে জাতীয় আদর্শে শিক্ষাদানের জন্য 92 জন সদস্য নিয়ে 1906 সালের 12 মার্চ একটি পরিষদ গঠন করা হয়। এর নাম হল- ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন’ বা ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাসবিহারী ঘোষ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত জাতীয় শিক্ষার পরিকল্পনা রচনা করেন। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রথম সভাপতি হলেন রাসবিহারী ঘোষ। প্রথম যুগ্ম সম্পাদক হলেন আশুতোষ চৌধুরী এবং হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট হল সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং অধ্যক্ষ হলেন অরবিন্দ ঘোষ।

(1) সংগঠনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য : এই পরিষদকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দেওয়া হবে বলে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরি হয়। 1906 সালের 14 আগস্ট রাসবিহারী ঘোষের সভাপতিত্বে কলিকাতার টাউন হলে এক বিরাট সভায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ অনুমোদিত ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল’ স্থাপনের কথা ঘোষণা করা হয়। স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত জনতার সামনে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন তাঁরা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা করবেন না। জাতীয় ভাবধারায় সম্পূর্ণ জাতীয় নিয়ন্ত্রণে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করবে এই পরিষদ। প্রচলিত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিকূল হবে না কিন্তু সরকারি ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্বাধীন থাকবে।

(2) শিক্ষা পরিকল্পনা : শিক্ষাদান ও বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপারে অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেন। ভারতীয় শিক্ষা পরিষদের শিক্ষা পরিকল্পনার যেসব বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়, তা হল-

  1. শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার এবং আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি চর্চার ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা স্তরে ভারতীয় সংস্কৃতি আলোচনা ও পঠন-পাঠনের জন্য সংস্কৃত, পালি, মারাঠি ও হিন্দি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
  2. বিদ্যালয় বা মাধ্যমিক স্তর থেকে বিজ্ঞান পাঠের ব্যবস্থা করা হয়। কলেজ এবং উচ্চশিক্ষা স্তরেও বিজ্ঞানশিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হয়।
  3. বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে সঙ্গে কলা, সংস্কৃতি ও মানবিক বিদ্যাচর্চার ব্যবস্থা করা হয়।
  4. ধর্মীয় নীতি ও শারীরশিক্ষার ব্যবস্থা করা।
  5. কলা, বিজ্ঞান ও কারিগরিবিদ্যা-এই তিনটি শাখায় কলেজের পাঠক্রমকে ভাগ করা যায়।
  6. বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য কলেজে কারিগরি বিভাগ খোলা হয়।
  7. বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় তাত্ত্বিক বিভাগ ছাড়া ব্যাবহারিক জ্ঞানের উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
  8. প্রয়োগমূলক কাজ হিসেবে কাঠের কাজ, লোহার কাজ, ঢালাইয়ের কাজ, যন্ত্রপাতি চালানো ইত্যাদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
  9. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, কলা, বিজ্ঞান প্রভৃতি  বিষয়ে গবেষণার ব্যবস্থা করা।

(3) জাতীয় কলেজের বিভিন্ন বিভাগ : জাতীয় কলেজে 4টি বিভাগ হল- সাহিত্য, বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কারিগরি। সাহিত্য বিভাগে শিক্ষাতত্ত্ব • আলোচিত হয়। বিনয় সরকারের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল- ‘বঙ্গে নবযুগের শিক্ষা’, ‘শিক্ষায় বিজ্ঞানের ভূমিকা’, ‘ভাষা শিক্ষা’, ‘শিক্ষা সোপান’, ‘শিক্ষা সমালোচনা’ ইত্যাদি সাহিত্য বিভাগে স্থান পায়। বিজ্ঞানে ছিল পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা ইত্যাদি। কারিগরি বিভাগে হাতেকলমে ৪ জিনিস তৈরি যেমন-পেনসিল, কারখানা গড়া, পাইপ মেরামতি ইত্যাদি।

(4) পাঠক্রম :

  • 6-9 বছর বয়সের জন্য প্রাথমিক স্তর: সাহিত্যধর্মী পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার প্রাথমিক পর্ব থাকবে। নির্দিষ্ট পাঠ্য বইয়ের ব্যবস্থা ছিল না। মুখে মুখে পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল।
  • 9-16 বছরের মাধ্যমিক স্তর: সাহিত্যধর্মী, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ের ব্যবস্থা ছিল। ওয়ার্কশপের কাজ ছিল আবশ্যিক।
  • কলেজ স্তর: সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরিতে দক্ষতা এবং বিশেষীকরণের স্তর।
  • মানবিক পাঠক্রম: মাতৃভাষা, ইংরেজি, প্রাচীন ভারতীয় ভাষা, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি ভাষা।
  • বিজ্ঞান পাঠক্রম: রসায়ন, শারীরবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ভূবিদ্যা প্রভৃতি।
  • কারিগরি পাঠক্রম: বিষয় বাছাই করার অধিকার ছিল ছাত্রদের।

(5) অনুমোদনের ব্যবস্থা: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সহায়তায় একের পর এক জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। 1907 খ্রিস্টাব্দে 10 টি স্কুল স্বীকৃতি পায় এবং আরও 5 টির জন্য সুপারিশ করা হয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাছে। জাতীয় প্রাথমিক স্কুল তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের বাইরেও কয়েকটি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন স্কুলগুলিতে গ্রন্থাগার, পরীক্ষাগার ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষা পরিষদ থেকে অনুদানের ব্যবস্থাও করা হত। স্কুলে পরিদর্শনের ব্যবস্থাও করা হয়।

(6) কারিগরি শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি: 1906 সালে তারকনাথ পালিত প্রতিষ্ঠিত কারিগরি শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি-র সঙ্গে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ চ যুক্ত হল। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের Bengal National College এবং Bengal Technical Institute সংযুক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় Central National Institution I এত কিছু সত্ত্বেও জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। Bengal National College 1917 সালে বন্ধ হয়ে Bengal National Academy-তে পরিণত হয়। 1920 সালে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। Bengal Technical Institute ক্রমে College of Engineering and Technology- তে রূপান্তরিত হয়। জাতীয় পরিষদ সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা প্রার্থনা করেন। 1955 খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বরে বিধানসভায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বিল উত্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, 1956 সালে এই প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বাংলা তথা ভারতবর্ষে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment