ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন কে, কার নেতৃত্বে, কবে নিয়োগ করেন? কার্জনের শিক্ষানীতি সংক্রান্ত প্রস্তাবে তৎকালীন শিক্ষা পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে কী বলা হয়েছিল? ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কমিশনের সুপারিশগুলি সম্পর্কে লেখো

1854 সালে উডের ডেসপ্যাচ বা উডের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এই প্রতিবেদনের নির্দেশ অনুযায়ী 1857 সালে ওটি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে মাধ্যমিক ও কলেজীয় শিক্ষার প্রসার ঘটে ফলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় শিক্ষাক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিস্থিতি বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস জরুরি হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় লর্ড কার্জন 1902 সালের 27 জানুয়ারি স্যার টমাস র্যালের নেতৃত্বে ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ নিয়োগ করেন।
কার্জনের শিক্ষানীতি সংক্রান্ত প্রসারে তৎকালীন পরিস্থিতির পর্যালোচনা
ভারতবর্ষের শিক্ষা তথা সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংক্রান্ত নীতির ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সিমলা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলি সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে এগুলির উপর ভিত্তি করেই এই শিক্ষানীতি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার এক সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি তৎকালীন পরিস্থিতিরও পর্যালোচনা করা হয়, যথা-
(1) কার্জনের শিক্ষানীতির প্রথম অংশেই হান্টার কমিশনে উল্লিখিত সুপারিশের ভিত্তিতে গৃহীত ব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
(2) আলোচ্য সময়ে জনশিক্ষার যে বিশেষ প্রসার ঘটেনি, সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে।
(3) শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাবের অপর অংশে বলা হয়েছে, দেশে পাঁচটির মধ্যে চারটি গ্রামে কোনো বিদ্যালয় নেই। এখানে চারজন শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনজন শিক্ষিত নয়।
(4) নারীশিক্ষার বিশেষ অভাবের কথাও এই অংশে উল্লেখ করা হয়। বলা হয় যে, এখানকার চল্লিশজন মেয়ের মধ্যে একজন মাত্র শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই শোচনীয় অবস্থা দূর করে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কার্জনের শিক্ষানীতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় যা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশসমূহ
(1) নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বন্ধের সুপারিশ: ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের মত অনুযায়ী, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ আর কোনো নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উপযোগী হয়নি-তাই দেশে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা নেই। এ ছাড়া এই কমিশন আলিগড়, নাগপুর, ব্যাঙ্গালোর, ত্রিবান্দ্রম প্রভৃতি স্থানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ বন্ধ রাখার সুপারিশ করে।
(2) শিক্ষণধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা এবং আঞ্চলিক সীমা নির্ধারণ: ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ভারতে প্রতিষ্ঠিত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষণধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়রূপে গঠনের বিরুদ্ধে সুপারিশ করে। কমিশন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক সীমা নির্ধারণ করারও সুপারিশ করে।কমিশনের রিপোর্টে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষমতা বৃদ্ধিরও প্রস্তাব ছিল।
(3) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার দায়িত্ব: স্নাতক স্তরের শিক্ষার দায়িত্বভার কলেজগুলি ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় পালন করবে বলে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষার সুবিধার্থে শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা দেওয়া হবে।
(4) প্রশাসন সংক্রান্ত সুপারিশ: এই কমিশনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সিনেটের সদস্যসংখ্যা হ্রাসের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া সদস্যদের কার্যকাল হবে পাঁচ বছর এবং আরও বলা হয় যে, প্রতি বছর পাঁচ ভাগের এক ভাগ সদস্যদের অবসর গ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে। সুপণ্ডিত, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী প্রমুখ যাতে সিনেটে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায় সেই ব্যবস্থা করার উল্লেখ করা হয়।
(5) কলেজ অনুমোদন সংক্রান্ত সুপারিশ: ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন কলেজগুলির অনুমোদনের জন্য আরও কতকগুলি বিষয় নির্দিষ্ট করে দেয়। এগুলি হল কলেজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসংগ্রহ, শিক্ষার মান বজায় রাখা, নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয়গুলি গুরুত্ব সহকারে বিচার করে অনুমোদন দিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
(6) শিক্ষার্থীদের কল্যাণের সুপারিশ: শিক্ষার্থীদের কল্যাণ তথা তাদের সুযোগসুবিধার কথা বিবেচনা করে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন পরীক্ষাগার, ছাত্রাবাস, গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ প্রভৃতি গড়ে তোলার সুপারিশ জানায়।
(7) অন্যান্য সুপারিশসমূহ :
(1) প্রবেশিকা পরীক্ষার মানোন্নয়ন করে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার বিলোপ এবং তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়।
(2) উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বহিরাগত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা প্রবর্তন করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন কর্তৃক কলেজের অনুমোদন ব্যবস্থার কড়াকড়ি, দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত কলেজের বিলোপসাধন বহিরাগত শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে কঠোর বিধি প্রণয়ন প্রভৃতি বিষয়গুলি সমালোচিত হয়েছে। তবে, উপযুক্ত অধ্যাপকমণ্ডলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গ্রন্থাগার, তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রভৃতি সুপারিশগুলি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর