লর্ড কার্জনের সঙ্গে জাতীয় নেতাদের বিরোধের কারণগুলি কী কী

লর্ড কার্জনের সঙ্গে জাতীয় নেতাদের বিরোধের কারণ
লর্ড কার্জনের সঙ্গে জাতীয় নেতাদের বিরোধের কারণগুলি হল-
(1) 1901 সালের শিক্ষাসম্মেলনে ভারতীয় শিক্ষাবিদদের না ডাকা : জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতবাসী যখন শিক্ষার প্রসারে ব্যগ্র অথচ সরকারি চাকরি সংস্থানের অক্ষমতায় শিক্ষার দ্রুত প্রসারে ভীত, এমন এক পরিস্থিতিতে লর্ড কার্জন একজন জবরদস্ত শাসক হিসেবে 1899 সালে ভারতের ‘গভর্নর জেনারেল’ (বড়োলাট) হয়ে আসেন। শিক্ষা সম্পর্কে উৎসাহী কার্জন ভারতীয় শিক্ষার নানা দিক পরীক্ষা করে শিক্ষা সংস্কারে ব্রতী হন। 1901 সালে ভারতীয় শিক্ষাবিদদের একেবারে বাদ দিয়ে সিমলাতে শিক্ষা-অধিকর্তা ও শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়ে এক শিক্ষা সম্মেলনের আহ্বান করেন তিনি। এতে তার সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই ভালো না হওয়ার কথা। কারণ ভারতীয় শিক্ষাবিদদের বাদ দিয়ে ভারতীয় শিক্ষা সংস্কারের জন্য সম্মেলন করলে তা জাতীয় নেতাদের অসন্তোষের কারণ হবে।
(2) ভারতীয় সদস্য ছাড়াই কার্জন কর্তৃক ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন: সিমলা সম্মেলনের সমীক্ষায় যখন কার্জন দেখলেন উচ্চ শিক্ষাদান ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ব্যর্থ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দুর্বল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য তিনি 1902 সালে ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন। এতেও কোনো ভারতীয় শিক্ষাবিদদের প্রথমে রাখা হয়নি। ফলে জাতীয়তাবাদী ভারতীয় নেতাদের অসন্তোষ আরও বেড়ে গেল, জনমতের চাপে পরবর্তীকালে কার্জন দুজন ভারতীয়কে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (1902 সাল)-এ অন্তর্ভুক্ত করেন। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, 1904 সালে কার্জন ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ বিধিবদ্ধ করেন।
(3) সিনেটের সংস্কার: সিনেটের সদস্য সংখ্যা 50 থেকে 100-র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। সিনেটের সদস্য পদের কার্যকাল থাকবে 5 বছর। ৪০% সদস্যরাই সরকার মনোনীত হবেন। এটাও জাতীয়তাবাদী নেতাদের মনে অসন্তোষ যা সৃষ্টি করে এবং তাঁদের কার্জনবিরোধী করে তোলে।তি
(4) নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের অমনোযোগ : কার্জনের 1904 সালের ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের’প্রায় সব সুপারিশই অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও তখন ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা আলিগড়, নাগপুর, ব্যাঙ্গালোর ইত্যাদি কয়েকটি জায়গায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু 1902 সালের শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে f সেটির কোনো উল্লেখ না থাকায় ‘ভারত আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উপযোগী নয়’ কমিশন এই মত প্রকাশ করায় উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি স্থাপনের কোনো কথা 1904 সালে ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনে’তথা – কার্জনের শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত হয়নি। এটাও জাতীয়তাবাদী নেতাদের অসন্তোষ যা কার্জনের সঙ্গে বিরোধের একটি কারণ।
(5) লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংকোচন নীতি: জাতীয়তাবাদীদের লর্ড কার্জনের সঙ্গে বিরোধের অন্যতম কারণ ছিল তাঁর ‘শিক্ষাসংকোচন নীতি। তিনি ভারতীয় নেতৃবৃন্দের শিক্ষাসংস্কারের দাবিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কঠোর শিক্ষা সংকোচনের নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা যায়। আগুনে ঘি দেওয়ার মতো বা বারুদের অগ্নিসংযোগের মতো জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনকারীদের অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলন জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করার জন্য স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্ররা দলে দলে যোগ দেয় এবং তাঁরা স্কুল-কলেজ বয়কট করায় তাদের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন শুরু হয় এবং জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন তীব্রতর আকার ধারণ করে।
সুতরাং, জাতীয়তাবাদী ভারতীয় নেতাদের লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জমতে জমতে তার সঙ্গে বিরোধের পরিণতিতে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন জোরদার হয়।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর