শিক্ষাবিস্তারে দিনেমার মিশনারিদের অবদান লেখো। সমাজ সংস্কারে শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকা কী ছিল? শ্রীরামপুর ত্রয়ীর পাঁচটি কার্যাবলি লেখো

শিক্ষাবিস্তারে দিনেমার মিশনারিদের অবদান
শিক্ষাবিস্তারের জন্য দিনেমার মিশনারিদের মধ্যে জিগেনবাল্প (Zegenbalg) এবং প্লুচাও (Plütschau) বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। 1713 সালে তাঁরা তামিল ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে দেশীয় ভাষায় বই ছাপার ব্যবস্থা করেন, 1716 সালে। ত্রারিকুয়েবারে তাঁর একটি শিক্ষক-শিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। 1717 খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে গরীব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য চাঁদা তুলে দুটি চ্যারিটি স্কুল খোলা হয়। দক্ষিণভারতের অ-খ্রিস্টান ছেলেমেয়েদের জন্য বহু বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এখানে স্থানীয় ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হত। শিক্ষক-শিক্ষণ ও ধর্মীয় সেমিনারিতে ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। ডেনমার্ক থেকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে ইংল্যান্ডের Society for promoting christion knowledge নামে (সংক্ষেপে SPCK) একটি প্রতিষ্ঠান থেকে দিনেমার মিশনারিদের আর্থিক সাহায্য করে। এর সাহায্য তাঁরা ভারতে শিক্ষার কাজ চালিয়ে যান।
সমাজ সংস্কারে শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকা
সামাজিক কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জনসচেতনতা জাগ্রত করতে শ্রীরামপুর মিশন সচেষ্ট হয়েছিল। সতীদাহ প্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন ইত্যাদি কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। উইলিয়াম কেরির রিপোর্টের ভিত্তিতে 1802 সালের ওয়েলেসলি গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের মতো কুপ্রথা নিষিদ্ধ করেছিলেন। সমাচার দর্পনে বিধবাবিবাহের পক্ষে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কুষ্ঠরোগীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়। অনেকেই মনে করেন, মিশনারিরা সামাজিক কু-সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বলেই হিন্দু নেতারা সচেতন হন এবং হিন্দুধর্ম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
শ্রীরামপুর ত্রয়ীর কার্যাবলি
(1) শ্রীরামপুর ত্রয়ীর মুখ্য উদ্দেশ্য পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ হলেও দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে তারা বাতিল করেনি। পাশাপাশি মাতৃভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ব্যাকরণ, গণিত ও প্রাথমিক গণনা, প্রাথমিক ভূগোল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস ও নীতিশিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
(2) ভারতে মুদ্রণ শিল্পের প্রবর্তন শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগেই সম্পন্ন হয়েছিল। কেরি ও তাঁর সহযোগীরা শিক্ষাবিস্তার করতে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকের অভাব বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সেইসময় পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন মূলত বাইবেল ছেপে বিতরণের উদ্দেশ্যে।
(3) এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য বই নিউ টেস্টামেন্ট ও ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর আংশিক অনুবাদ, কেরির লেখা ‘গসপেল অফ মেমু’-র অনুবাদ হয়। মিশনারিরা সংস্কৃত শিখে অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন। যেমন-শুদ্ধবোধ ব্যাকরণ, কেরির সংস্কৃত ব্যাকরণ, কেরি ও মার্শম্যান সম্পাদিত বাল্মীকি ব্যাকরণ, রামায়ণ ইত্যাদি। এ ছাড়াও রাজীবলোচন উপাধ্যায়ের ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রহস্য চরিতম’ এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘রাজাবলি’, ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ ইত্যাদি।
(4) মিশনের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যে কমিটি গঠন হয়েছিল, সেখানে ছিলেন, উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম ওয়ার্ড ও জসুয়া মার্শম্যান। মিশনের শিক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে Andrew Bell মনিটর প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষণের জন্য 1818 সালে মিশন নর্মাল স্কুলও স্থাপন করেন।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর