মুসলিম যুগে শিক্ষার সুবিধাগুলি কী কী ছিল
অথবা, ভারতীয় সভ্যতার ইসলামীয় প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো
অথবা, ইসলামিক শিক্ষার অবদান আলোচনা করো

মুসলিম যুগে শিক্ষার সুবিধা বা অবদান
ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থা মধ্যযুগের ভারতে সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তাই এই শিক্ষা অনেক বেশি বিস্তারলাভ করেছিল। এই শিক্ষার অবদানগুলি হল-
(1) বাস্তব চাহিদা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সমন্বয় : বাস্তব চাহিদা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সমন্বয় ছিল মুসলিম যুগের শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাদের কাছে শিক্ষা ছিল ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি। মুসলিম শিক্ষা বাস্তবজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল।
(2) আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি: ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধি। এই কালপর্বে প্রাদেশিক বাংলা, হিন্দি, মারাঠি প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষার প্রবল উৎকর্ষ সাধিত হয় ও এগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বিশাল সাহিত্যসম্ভার। সুলতানি যুগে স্বাধীন বাংলায় হুসেন শাহ, নুসরৎ শাহের আমলে রামায়ণ ও মহাভারত বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। এ ছাড়া বাংলা ভাষা ও অনুবাদ সাহিত্যের ইতিহাসে পরাগল খাঁ ও ছুটি খাঁ-র নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়।
(3) শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক : শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল সহযোগিতার। শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রতি ব্যক্তিগত যত্ন নিতে এবং যোগ্য ও বুদ্ধিমান ছাত্ররা তাদের যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ পেত।
(4) বৈতনিক ও আবাসিক: মুসলিম শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ার ফলে সকল শ্রেণির ছাত্ররা শিক্ষার সুযোগ পেত। এ ছাড়াও এই শিক্ষা ছিল আবাসিককেন্দ্রিক। ফলে একত্রে বসবাসের ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
(5) ইতিহাস ও সাহিত্যের সংরক্ষণ ও অগ্রগতি: মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় ঐতিহাসিক তথ্য সংরক্ষণের রীতি প্রচলিত ছিল। যেমন- মুঘল সম্রাটদের জীবনী এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যেও বিশেষ অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। চৈতন্যদেবের জীবনকে অবলম্বন করে রচিত হয় ‘চরিত সাহিত্য’ যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পরাগল খাঁয়ের ছেলে ছুটি খাঁ মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব বাংলায় অনুবাদ করেন।
(6) সংস্কৃতির সমন্বয় : মুসলিম শিক্ষায় সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল। মধ্যযুগে এই শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি সাধারণভাবে হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল। পাশাপাশি থাকার ফলে এই দুটি শিক্ষার মধ্যে একটি সমন্বয়ের ধারা গড়ে ওঠে। সংস্কৃত, ফারসি ভাষার গ্রন্থগুলি অন্য ভাষায় অনুবাদের ফলে ভাষা-সাহিত্য সমৃদ্ধ হয় এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন গড়ে ওঠে।
(7) উর্দু ভাষার উৎপত্তি: মধ্যযুগে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনকালে হিন্দু- মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভাবের মেলবন্ধনে উর্দু ভাষার সৃষ্টি হয়। ফারসি ও আরবি ভাষার সঙ্গে হিন্দু ভাষার মিলিত শব্দ ও ভাবধারা উর্দুর মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। তাই বলা যায়, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধনে ভাষার অবদান অনবদ্য।
(8) পাঠক্রাম বৈচিত্র্য: ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠক্রম একেবারেই একঘেঁয়ে ছিল না। তা ছিল বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। ফলে তা শিক্ষার্থীদের সহজেই আকর্ষণ করত ও এর মাধ্যমে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের প্রসার ঘটত।
(9) সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্যশিল্প: মধ্যযুগের ইসলামিক শিক্ষার আদবকায়দা চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। সে যুগের স্থাপত্য, ভাস্কর্য আজও সকলের কাছে দর্শনীয় বস্তু। আবার রবিদাস, রামদাস, তানসেন প্রমুখ হিন্দু-মুসলিম গুণীজনের সমন্বয় সংগীতেও বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
(10) শৃঙ্খলা: কোরান এবং অন্যান্য ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী, শিক্ষাজীবন পরিচালিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানে সর্বদা শৃঙ্খলা বজায় থাকত। 1
(11) বৃত্তিশিষ্কার সুযোগ: সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি এই যুগে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থাও
(12) পুরস্কার প্রদান: শিক্ষায় উৎসাহ বর্ধনের জন্য মেধাবী ছাত্রদের উপযুক্ত পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা ছিল।
(13) নৈতিক বিকাশ : শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাতে নীতিবোধ জাগ্রত হয়, তার জন্য তাদের নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হত।
(14) শিক্ষার প্রসার: মুসলিম শিক্ষার প্রসারের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক মক্তব ও মাদ্রাসার উদ্ভব হয়েছি উপরোক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, মুসলিম শিক্ষা ত্রুটিমুক্ত নয়। কারণ মুসলিম যুগে শিক্ষা সর্বজনীন ছিল না। ইসলাম ধর্মের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। নারীশিক্ষাও ছিল অবহেলিত। এ ছাড়া মাতৃভাষার গুরুত্ব ছিল কম। লৌকিক শিক্ষারও বিশেষ অভাব ছিল তা সত্ত্বেও নানা উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছিল। তাই বলা যায়, মধ্যযুগের ভারতে ইসলামিক শিক্ষার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর