শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের অর্থ প্রশ্ন উত্তর (Marks 5) | Class 11 Second Semester WBCHSE

শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের অর্থ প্রশ্ন উত্তর (Marks 5) | Class 11 Second Semester WBCHSE

শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের অর্থ প্রশ্ন উত্তর
শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের অর্থ প্রশ্ন উত্তর

১। Psychology-র ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আলোচনা করো। মনোবিদ্যা বা মনোবিজ্ঞানের ধারণাগত পরিবর্তন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করো।

ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: Psychology শব্দটির বাংলা অর্থ মনোবিদ্যা। আজ থেকে প্রায় দু-হাজার বছর পূর্বে এই Psychology শব্দটি গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ট্ল তাঁর ‘De-Anima’ নামক গ্রন্থে প্রথম উল্লেখ করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতকে তা একটি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে প্রাধান্য পায়।

সূচিপত্র

1789 খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম উন্ড-এর দ্বারা Psychology বা মনোবিজ্ঞান- এর ধারা শুরু হয়। Psychology শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ Psyche এবং Logos থেকে উৎপত্তি হয়েছে। Psyche কথার অর্থ হল Soul বা আত্মা এবং Logos কথার অর্থ Science বা বিজ্ঞান। যা একসঙ্গে-Psychology is Science of Soul অর্থাৎ মনোবিজ্ঞান হল আত্মার বিজ্ঞান।

মনোবিদ্যার ধারণাগত পরিবর্তন

এই মনোবিজ্ঞানের ধারণার পরিবর্তিত রূপ লক্ষ করা যায়, তা হল

আত্মার বিজ্ঞান: Psychology শব্দটিকে প্রথমে আত্মার বিজ্ঞান (Science of Soul) বলেছেন- অ্যারিস্টট্ল। এটিকে অনেকে সমর্থন করেছেন, যেমন- প্লেটো, ডেমোক্রিটাস।

মনের বিজ্ঞান: মনোবিদ ডেকার্তের মতে, মনোবিদ্যার বিষয়বস্তু হল মন (Mind)। এর কাজ হবে মনের বিভিন্ন কাজকে অনুশীলন করা। মনোবিদ হোলডিং মনোবিজ্ঞানকে মনের বিজ্ঞান (Psychology is the Science of Mind) বলে উল্লেখ করেছেন। হোলডিং, টিচেনার, কান্ট, ম্যাকডুগাল প্রমুখ ব্যক্তিগণ মনকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

চেতনার বিজ্ঞান: চেতনার মধ্যেই মনের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। উইলিয়াম জেমস বলেছেন- Psychology is the Science of Consciousness, মনোবিদ অ্যাঙ্গেল চেতনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য মনোবিজ্ঞানের নিজস্ব পদ্ধতি অন্তর্দর্শনকেও উল্লেখ করেছেন।

আচরণের বিজ্ঞান: ওয়াটসন বলেছেন, মানুষের আচরণ অনুশীলন করাই হল মনোবিদ্যার উদ্দেশ্য (Psychology is the Science of human behaviour) এবং পরবর্তীকালে ম্যাকডুগাল বলেছেন, মনোবিদ্যা হল প্রাণীর আচরণ অনুশীলনকারী বিজ্ঞান (Psychology is the Positive Science of the behaviour of living beings) I

এই সমস্ত সংজ্ঞাগুলি বিবেচনা করে Woodworth বলেছেন, First Psychology lost his soul, then it lost its mind, then it lost consciousness, it still has behaviour of a kind অর্থাৎ প্রথমে – আত্মা পরে মন, তারপর চেতনা হারিয়ে মনস্তত্ত্ব এখন আচরণের বিজ্ঞান নামে পরিচিত।

মনোবিদ্যার এইসব বক্তব্য বা সংজ্ঞা থেকে তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো আমাদের পক্ষে সত্যিই মুশকিল। দার্শনিক থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন মনোবিদের সংজ্ঞাগুলিকে আলোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেকেই এক একটি দিকের উপর জোর দিয়েছেন। এদের কোনো একটিকে বাদ দিয়ে মনোবিদ্যা চলতে পারে না। মনোবিদ্যার উদ্দেশ্য হল মানুষকে জানা আর তার বিষয়বস্তু হল দেহ, মন নিয়ে সম্পূর্ণ একজন ব্যক্তি।

২। মনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলোচনা করো। আধুনিক মনোবিদ্যার প্রধান দুটি শাখা সম্পর্কে লেখো।

মনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি

কয়েকটি মাপকাঠির ভিত্তিতে মনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি নির্ধারণ করা হয়। যেগুলি হল-

[1] সুসংগঠিত ভত্ত্ব: মনোবৈজ্ঞানিক নীতির উপর ভিত্তি করে সুসংগঠিত তত্ত্বমূলক জ্ঞান।

[2] প্রয়োগমূলক দিক : শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন, শিল্প ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ রয়েছে।

[3] আচরণগত দিক:

(i) উৎস ও উপাদান: প্রতিটি আচরণের উৎস, কার্যকারণগত উপাদান ও প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান রয়েছে।

(ii) আচরণ বিশ্লেষণ: আচরণ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আদর্শ মতামতের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

(iii) আচরণ অনুশীলন: আচরণ অনুশীলনে যেসব পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করা হয়, তা সর্বদাই বিজ্ঞানসম্মত হয়ে থাকে।

(iv) আচরণের ফলাফল: আচরণের ফলাফল বিচারের ক্ষেত্রে পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

(v) আচরণের নিয়মনীতি: আচরণের নিয়মনীতি সর্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য।

(vi) আচরণের বিশ্লেষণ ও পরিমাপ: মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমে আচরণের সঠিক বিশ্লেষণ ও পরিমাপ করা যায়।

আধুনিক মনোবিদ্যার শাখা

আধুনিক মনোবিদ্যার প্রধান দুটি শাখা হল- (i) বিশুদ্ধ মনোবিজ্ঞান, (ii) ব্যাবহারিক বা ফলিত মনোবিজ্ঞান।

(i) বিশুদ্ধ বা তাত্ত্বিক মানাবিজ্ঞান: বিশুদ্ধ বা তাত্ত্বিক মনোবিজ্ঞানে, মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন নিয়মনীতি, পদ্ধতি, পরিকল্পনা, কৌশল প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর বিভিন্ন শাখাগুলি হল- সাধারণ মনোবিদ্যা, অস্বাভাবিক মনোবিদ্যা, পরীক্ষামূলক মনোবিদ্যা, সমাজ মনোবিদ্যা, শিশু মনোবিদ্যা, শারীরবৃত্তীয় মনোবিদ্যা, বিকাশমূলক মনোবিদ্যা।

(ii) ব্যাবহারিক বা ফলিত মানাবিজ্ঞান: প্রয়োগমূলক মনোবিজ্ঞান হল মনোবিজ্ঞানের একটি ফলিত শাখা। সেখানে শিক্ষার্থীর শিক্ষাকালীন কর্মপ্রক্রিয়া ও আচরণসমূহ নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করা হয়। প্রয়োগমূলক মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাগুলি হল- শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, • আরোগ্য মনোবিজ্ঞান, শিল্প মনোবিজ্ঞান, সামরিক মনোবিজ্ঞান, রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞান, অন্যান্য মনোবিজ্ঞান।

৩। মনোবিজ্ঞানকে কি বিজ্ঞান বলা যায়? উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।

বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞান

মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে বিষয়কে অধ্যয়ন করা হয়, সেগুলি হল- ব্যক্তির আচরণের সঠিক অনুমানের প্রচেষ্টা, চিন্তনের পথ বিকশিত করে অনুসন্ধানের সঠিক দিক-কে (গতানুগতিক বিশ্বাস, সাধারণ জ্ঞানগুলির পর্যবেক্ষণ) পরীক্ষণের মাধ্যমে যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা, মানব আচরণ বিশ্লেষণ, অনুশীলন, বিচারকরণ, পরিমাপ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ, যেসব বিষয়ের উপর মনের আচরণ নির্ভর করে (যাকে বলে চলক) সেগুলিকে জানার প্রচেষ্টা, চলকগুলি আচরণের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করার ফলে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেই তথ্যগুলিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা, চলক নিয়ন্ত্রণ করে তথ্য অনুসন্ধান ও পুনঃঅনুসন্ধানের মাধ্যমে নৈর্ব্যক্তিক ফলাফলদানের প্রচেষ্টা, মনোবৈজ্ঞানিক ফলাফলকে ব্যাবহারিক জীবন ও ভবিষ্যৎ গবেষণায় প্রয়োগ।

সুতরাং মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেই কারণে মনোবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান এবং মানুষের আচরণের উপর যেহেতু গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাই এটি আচরণগত বিজ্ঞান। তবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলিতে যেসব অনুমান করা হয়, সেগুলিকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা যায় এবং যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সেগুলির নৈর্ব্যক্তিকতা রয়েছে। এই বিজ্ঞানগুলিতে পরীক্ষামূলকভাবে পর্যবেক্ষণের পর তা থেকে সিদ্ধান্তে আসতে হয়। তাই এই বিজ্ঞানগুলিকে উন্নত ইতিবাচক বিজ্ঞান (Developed Positive Science) বলে।

অপরপক্ষে, মনোবিজ্ঞান আচরণ নিয়ে আলোচনা করে যা পরিবর্তনশীল, অনেকক্ষেত্রে অনুমান করা যায় না, অনেকক্ষেত্রে অনুমান করলেও তাকে পরীক্ষামূলকভাবে সত্যতা প্রমাণ করা কঠিন, যেসব পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হয় সেগুলিও সবসময় নৈর্ব্যক্তিক নয়। এই কারণে প্রকৃতিবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলির মতো মনোবিজ্ঞানকে ইতিবাচক বিজ্ঞান বলা যাবে না, যেহেতু মানব আচরণ পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরিমাপযোগ্য তাই এটিকে উন্নয়নশীল ইতিবাচক আচরণ বিজ্ঞান (Developing positive science of behaviour) অবশ্যই বলা যায়।

৪। মনোবিদ্যা আচরণ সম্পকীয় বিজ্ঞান- আলোচনা করো।

মনোবিদ্যা আচরণ সম্পকীয় বিজ্ঞান

1913 সালে মনোবিদ ওয়াটসন (J B Watson) বলেন, “Psychology is the science of human behaviour.” অর্থাৎ মনোবিজ্ঞান হল আচরণ অনুশীলনকারী বিজ্ঞান। 1949 সালে মনোবিদ ম্যাকডুগাল (McDougall) বলেন, “Psychology is the positive science of the living things.” অর্থাৎ মনোবিজ্ঞান হল জীবের আচরণ সম্বন্ধীয় বিষয়নিষ্ঠ বিজ্ঞান।

ম্যাকডুগাল ও ওয়াটসনের মতে: এখানে আচরণ বলতে ম্যাকডুগাল প্রাণীর কোনো উদ্দেশ্যমূলক কাজকে বুঝিয়েছেন অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যপূরণ করার জন্য প্রাণী যে কাজ করে থাকে। অপরদিকে, ওয়াটসন আচরণ বলতে উদ্দীপকের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ যে প্রতিক্রিয়া করে, তাকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ ওয়াটসন মানব আচরণকে যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। ম্যাকডুগাল জীবের আচরণকে মনের বাহ্য প্রকাশ রূপেই গ্রহণ করেছেন। ফলে আত্মা, মন, চেতনা প্রভৃতি বিতর্কমূলক শব্দগুলিকে তিনি যেমন বর্জন করেছেন, তেমনই চেতন মনকে গ্রহণ করেছেন।

অন্যান্য মানাবিজ্ঞানীদের মতামত: 1976 সালে ডেসিডারেটো (Desiderato), হাউইসন (Howieson), জ্যাকসন (Jackson) প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীর মতে, “মনোবিজ্ঞান হল মানুষ-সহ অন্যান্য প্রাণীর আচরণ এবং ওই আচরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মানসিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির অনুসন্ধান।” উডওয়ার্থের (Woodworth) মতে, “Psychology is the science of the individual in relation to his environment” অর্থাৎ মনোবিজ্ঞান হল পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত বিজ্ঞান।

ডেসিডারেটো, হাউইসন এবং জ্যাকসন প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীরা তাঁদের সংজ্ঞায় যেখানে আচরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সামান্য শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়াগুলিকে বুঝিয়েছেন, ঠিক তেমনই উডওয়ার্থ তাঁর সংজ্ঞায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপকে বুঝিয়েছেন।

সুতরাং উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মনোবিজ্ঞান হল জীবের আচরণ সম্পর্কীয় বিজ্ঞান।

৫। মনোবিজ্ঞানের গুরুত্ব লেখো।

মনোবিজ্ঞানের গুরুত্ব

মনোবিজ্ঞানের তাৎপর্য বা গুরুত্বগুলি হল-

(i) মানবসভার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা: মনোবিজ্ঞানের দ্বারা শিশুর মানসিক ক্ষমতা, শারীরিক ক্ষমতা এগুলি সম্পর্কে অনুধাবন করা যায়।

(ii) ব্যন্ত্রিসভার বিকাশ ব্যাখ্যা করা: শিশু যে পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিবেশের পরিবর্তন হয়। পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সংগতিবিধানের জন্য শিশুকে তার আচরণের পরিবর্তন করতে হয় এবং এভাবেই চরিত্র গঠিত হয়। এসবের ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞান করে থাকে।

(iii) শিখন প্রক্রিয়া আলোচনা করা: শিশু কীভাবে শেখে, শিখনের নিয়মগুলি কী কী, শিখনের উপর প্রভাব বিস্তার করা উপাদানগুলি কী কী, শিখনের সঙ্গে শিশু শিক্ষার্থীর চাহিদার সম্পর্ক কী, এসবই মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।

(iv) বৃদ্ধির পরিমাপ করা: মনোবিজ্ঞানের সহায়তায় আমরা বুদ্ধির পরিমাপ অর্থাৎ বুদ্ধ্যঙ্ক যেমন নির্ণয় করতে পারি, তেমনই বুদ্ধি কী, কীভাবে তার বিকাশ ঘটে, সবকিছুই জানতে পারি।

(v) অভীক্ষাপত্র রচনা করা: মনোবিজ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষক মহাশয় উপযুক্ত অভীক্ষাপত্র রচনা করেন।

(vi) মানসিক প্রক্রিয়াগুলির ব্যাখ্যা করা: পরিণমনের স্তর কী, স্মৃতি কীভাবে বাড়ানো যায়, শ্রেণিকক্ষে কীভাবে প্রেষণা সৃষ্টি করা যায়, শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের উপায়গুলি কী কী ইত্যাদি বিষয় জানতে মনোবিজ্ঞানের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে।

(vii) সঠিক শিক্ষা ও বৃত্তি সম্পর্কে নির্দেশনা দান: প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ভালোভাবে জেনে সঠিক নির্দেশনা ও বৃত্তি নির্দেশনা দেওয়ার কাজও মনোবিজ্ঞান করে থাকে।

(viii) অপসংগতিমূলক আচরণ দূর করা: শিশুর বিভিন্ন অপসংগতিমূলক আচরণকে নির্ণয় করা এবং তার সমাধানের পথ নির্ণয় করে মনোবিজ্ঞান।

(ix) পরিচালনা ও মনোবিজ্ঞান: বিদ্যালয়ে উপযুক্ত পরিচালনার অভাবে সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ কাজে শিক্ষককে মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়।

(x) ক্লান্তি এবং অবসাদ দূরীকরণ ও মনোবিজ্ঞান: কীভাবে পড়াশোনার ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করা যায়, কীভাবে পাঠ করলে বিরক্তি কম আসে, সেই সম্পর্কে মনোবিজ্ঞান শিক্ষককে সাহায্য করে।

৬। শিক্ষা মনোবিজ্ঞান কাকে বলে? শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের লক্ষাগুলি বা উদ্দেশ্যগুলি আলোচনা করো।

শিক্ষা মনোবিজ্ঞান

মনোবিজ্ঞানের একটি ফলিত শাখা হল শিক্ষা মনোবিজ্ঞান। শিক্ষাক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগকেই বলা হয় শিক্ষা মনোবিজ্ঞান। এখানে ব্যক্তির শিক্ষাকালীন আচরণের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ, নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বাভাস দেওয়া হয়। স্কিনার-এর মতে, “শিক্ষা মনোবিজ্ঞান হল মনোবিজ্ঞানের একটি শাখা যা শিক্ষণ ও শিখন নিয়ে কাজ করে।” কোলেসনিক বলেছেন, “মনোবিজ্ঞানের যেসব তত্ত্ব ও নীতি শিক্ষা প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে ও উন্নত করতে সাহায্য করে, তাদের অনুশীলনই হল শিক্ষা মনোবিজ্ঞান।”*1

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য

শিক্ষা মনোবিদ্যার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর শিক্ষাকালীন আচরণ অনুশীলন করা। সাধারণভাবে বলা যেতে পারে এর উদ্দেশ্য হল এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করা যার সাহায্যে শিক্ষকেরা তাঁদের পেশাগত এবং সমাজগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পারেন। মনোবিদ Skinner শিক্ষা মনোবিদ্যার সম্পূর্ণ ক্ষেত্রকে বিশ্লেষণ করে কয়েকটি লক্ষ্যের উল্লেখ করেছেন। তা নিম্নে আলোচনা করা হল-

(i) বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ: শিক্ষার্থীর আচরণ তার বিভিন্ন প্রকার মানসিক প্রক্রিয়া এবং শিক্ষার্থীর বিকাশ প্রক্রিয়া সম্বন্ধে পরিপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা, এককথায় শিক্ষার্থী সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করা মনোবিদ্যার উদ্দেশ্য।

(ii) আচরণ অনুশীলন: শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর আচরণকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে অনুশীলন করা।

(iii) দৈনন্দিন শিক্ষাকার্য পরিচালনা: দৈনন্দিন শিক্ষাকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে শিক্ষককে নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অর্থাৎ পাঠ্যবস্তু কীভাবে সাজানো হবে, বিষয়বস্তু কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, কোন্ কৌশল অবলম্বন করলে সার্থক শিখন সম্ভব- সে সম্পর্কে সন্তোষজনক সমাধানের কৌশল আবিষ্কার করা শিক্ষা মনোবিদ্যার লক্ষ্য।

(iii) অভিযোজনে সহায়তা: শিক্ষা মনোবিদ্যার পরীক্ষণমূলক দিকের সাহায্যে শিক্ষার্থীকে সার্থকভাবে সমাজে অভিযোজনে সাহায্য করা হল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।

(iv) আদর্শের পথে এগিয়ে যাওয়া: শিক্ষার্থীর আচরণের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীকে আদর্শের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা শিক্ষা মনোবিদ্যার উদ্দেশ্য।

(vi) শিক্ষার্থী-শিক্ষাকর আচরণের মূল্যায়ন: শিক্ষার্থীর আচরণের গতি, তার প্রতিক্রিয়া এমনকি শিক্ষার্থী-শিক্ষকের আচরণের সার্থক মূল্যায়ন করাও শিক্ষা-মনোবিদ্যার লক্ষ্য।

(vii) পাঠদান ও বিদ্যালয়ের সংগঠান সহায়তা: পাঠদান বা বিদ্যালয়ের সাংগঠনিক ব্যাপারেও শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর হাতে এমন কিছু তথ্য সরবরাহ করা যাতে সহজে এগিয়ে যাওয়া যায়।

৭। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলোচনা করো।

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি

(i) প্রয়োগমূলক বিজ্ঞান: মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব, নীতি, সূত্র ইত্যাদি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকরী ও উন্নত করাই হল শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্যতম কাজ।

(ii) গতিশীল বিষয়: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের উপর প্রতিনিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণার ফলে একদিকে যেমন নতুন তথ্য, তত্ত্ব, নীতি, সূত্র আবিষ্কার হচ্ছে তেমনই পুরাতন নীতি, সূত্র, চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটছে, ফলে নিত্যনতুন পরিবর্তনের ফলে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে।

(iii) স্বতন্ত্র বিষয়: শিক্ষা মনোবিজ্ঞান যে একটি স্বতন্ত্র বিষয় তার কারণ হিসেবে বলা যায়- এটির পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত, বিষয়টির মধ্যে নিজস্ব সমস্যা আছে, বিষয়টির মধ্যে নিজস্ব পদ্ধতি আছে যার সাহায্যে তার সমস্যাগুলির সমাধানের পথ নির্ণয় করা যায়। শিক্ষামনোবিজ্ঞান এই সব শর্তগুলিই পূরণ করতে সক্ষম।

(iv) ব্যক্তি এ সমাজের পক্ষে কল্যাণকর: শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ব্যক্তির আচরণ সংশোধন করে, তার কল্যাণসাধন করে, ফলে ব্যক্তির কল্যাণসাধনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজেরও মঙ্গল সাধিত হয়।

(v) সংকীর্ণ পরিধি: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর শিক্ষাকালীন আচরণ পর্যালোচনা করা হয়। মানবপ্রকৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।

(vi) স্বতন্ত্র পরীক্ষামূলক দিক ও গবেষণাকেন্দ্র: মনোবিজ্ঞানের একটি ব্যাবহারিক শাখা হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এটি শিক্ষার্থীদের নানান আচার-আচরণ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রকৃতি, শিখন সঞ্চালনগত সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ে এককভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে সাফল্য অর্জন করে বিজ্ঞান মহলে গবেষণা ও অনুশীলন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে।

(vii) স্বতন্ত্র আলোচনার ক্ষেত্র: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষা সহায়ক উপকরণসমূহ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পরামর্শদান, অপসংগতি দূর করতে মনোবিজ্ঞানের সহায়তা নেওয়া হয়।

৮। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের পরিধি বা পরিসর আলোচনা করো।

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের পরিধি

(i) বংশধারা ও পরিবেশ: শিশুমন যেহেতু শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়, তাই শিশুর উপর তার বংশধারা ও তার পরিবেশ কেমন প্রভাব বিস্তার করে, তা শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।

(ii) সহজাত মানসিক সামর্থ্য: শিক্ষার্থী জন্মগ্রহণের সময় যেসব সামর্থ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে (যেমন-বুদ্ধি, প্রক্ষোভ, স্মৃতি, কল্পনা, চিন্তন, অনুভূতি ইত্যাদি) সেগুলির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নতির জন্য শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।

(iii) শিক্ষণ পদ্ধতি: উপযুক্ত শিক্ষণ পদ্ধতি ক্লান্তি, অবসাদ, বিরক্তি প্রভৃতিকে দূর করে শিক্ষাদানের কাজকে আকর্ষণীয় করে তোলে। এই শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়।

(iv) শিখন সঞ্চালন: শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতাকে কীভাবে বৃহত্তর সমাজজীবনে সঞ্চালন ঘটানো যায় এবং কীভাবে এই সঞ্চালনের পরিমাণ বাড়ানো যায়, তা শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়।

(v) ব্যক্তিবৈষম্য: শিক্ষার্থীদের মধ্যেকার বৈষম্যের কারণ কী, কোন্ কোন্ দিক দিয়ে এই বৈষম্য আসে এসবই শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়।

(vi) ইন্দ্রিয় অনুশীলন: ইন্দ্রিয়ের স্বরূপ ও অনুশীলন কীভাবে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হয়, তা শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।

(vii) মানসিক প্রক্রিয়া: শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়া যেমন- আবেগ বা অনুভূতি, আগ্রহ, মনোভাব, চিন্তন, কল্পনা, মনোযোগ ইত্যাদি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। এ ছাড়া স্নায়ুতন্ত্র ও তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।

(viii) শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ: শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের জন্য কী কী করা উচিত, সে বিষয়ে মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।

৯। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি আলোচনা করো।

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দিক

(i) শিক্ষার্থী: শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার অনুশীলন করতে এবং সেগুলির যথাযথ বিকাশসাধন করতে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের একান্ত প্রয়োজন।

(ii) শিক্ষক: আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষকের মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান না থাকলে, তিনি শিক্ষার্থীদের চাহিদাভিত্তিক এবং ব্যক্তিবৈষম্য অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করতে পারবেন না।

(iii) শিখন প্রক্রিয়া: শিখন প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তুলতে হলে শিক্ষকের শিখন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যিক।

(iv) শিখন পরিস্থিতি: নানান শিখন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রকার শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগ এবং কীভাবে তার উন্নতি সম্ভব সবই মনোবিজ্ঞানের গবেষণার ফল।

(v) শিক্ষামূলক প্রদীপন: শিক্ষক মনোবিজ্ঞানের সহায়তায় শিখন সহায়ক উপকরণের ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারেন।

(vi) বুদ্ধির পরিমাপ : মনোবৈজ্ঞানিক বিভিন্ন অভীক্ষার সাহায্যে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধির পরিমাপ বা বুদ্ধ্যঙ্ক নির্ণয় করা সহজ হয়েছে। IQ বা বুদ্ধ্যঙ্ক অনুযায়ী শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেলে সেই শিক্ষা অধিক বাস্তবগ্রাহী হয়।

(vii) শিখনের শর্তাবলি: শিক্ষার্থীর প্রেষণা, স্মৃতি, একাগ্রতা, মনোযোগ, সক্রিয়তা প্রভৃতি শিখনের গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের – আলোচ্য বিষয়। এ ছাড়া শিখনের বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন-আংশিক পদ্ধতি, – সামগ্রিক পদ্ধতি, সবিরাম পদ্ধতি, অবিরাম পদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্তর্গত।

মূল্যায়ন: শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার পরিমাপ করার জন্য মূল্যায়ন প্রক্রিয়ারূপে রাশিবিজ্ঞানের ব্যবহার করা হয়, যা শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

১০। শিক্ষা মনোবিদ্যার বিষয়বস্তুসমূহ ব্যাখ্যা করো।

শিক্ষা মনোবিদ্যার বিষয়বস্তুসমূহ

শিক্ষা মনোবিদ্যার কর্মপরিধি যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তবে দেখা যাবে শিক্ষা মনোবিদ্যার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়বস্তু রয়েছে। নীচে সেগুলি সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া হল-

(i) বিকাশ-সংক্রান্ত মানাবিদ্যা: মানুষের জীবনবিকাশের বিভিন্ন দিক (যেমন-দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক ইত্যাদি) এখানে আলোচিত হয়।

(ii) প্রেষণা-সংক্রান্ত নানাবিদ্যা: শিক্ষার্থীর বিভিন্ন আচরণের পিছনে কী কারণ রয়েছে অর্থাৎ শিক্ষার্থী কেন নানান ধরনের আচরণ করে, তার ব্যাখ্যা দেয় প্রেষণা (Motivation)। শিক্ষা যেহেতু আচরণ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সেহেতু এটি শিক্ষা মনোবিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

(iii) শিখন-সংক্রান্ত মনোবিদ্যা: শিক্ষার উদ্দেশ্যপূরণের জন্য শিখন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিখন যেমন বিভিন্ন প্রকারের হয় তেমনই শিখনের তত্ত্বগুলিও বিভিন্ন রকম এবং বিভিন্ন তত্ত্বের প্রয়োগক্ষেত্রও বিভিন্ন। এই কারণে শিক্ষা মনোবিদ্যায় শিখন-সংক্রান্ত আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ।

(iv) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মনোবিদ্যা: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিবৈষম্য মনোবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে পার্থক্য দেখা যায়, যেমন- বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, আগ্রহ, মনোযোগ, মনোভাব ইত্যাদি।

(v) অভিযোজনের মানাবিদ্যা: শিক্ষার্থীকে গৃহ ও বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অভিযোজন করতে হয়। সেইজন্য শিক্ষা মনোবিদ্যার অন্যতম একটি বিষয় হল অভিযোজন।

(vi) দলগত আচরণের মনোবিদ্যা: শ্রেণিকক্ষের দলগত আচরণের প্রকৃতি ও স্বরূপ সম্বন্ধে জানা প্রয়োজন। এই কারণে শিক্ষামনোবিদ্যায় দলগত আচরণ-সংক্রান্ত বিষয়বস্তু স্থান পেয়েছে।

১১। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য

(i) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্বদান: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ব্যক্তি অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে অধিক গুরুত্ব দেয়।

(ii) বিকাশমূলক বিজ্ঞান: প্রতিনিয়ত গবেষণার কারণে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব, সূত্র ও তথ্যের আবিষ্কার ও পরিমার্জন হচ্ছে। তাই একে বিকাশমূলক বিজ্ঞান বলে।

(iii) শিক্ষাক্ষেত্রে ভূমিকা: শিক্ষাক্ষেত্রে পদ্ধতি প্রকরণ, সমস্যাসমাধান, পাঠক্রম প্রণয়ন, গবেষণা, মূল্যায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান।

(iv) অন্তর্দর্শন: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের নিজস্ব পদ্ধতি হল অন্তর্দর্শন। যা মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা থেকে স্বতন্ত্র।

(v) আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান: শিক্ষা মনোবিজ্ঞান যেহেতু ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণকর বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করে, তাই একে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলে।

(vi) গতিশীলতা: মনোবিজ্ঞানের গবেষণার দ্বারা আবিষ্কৃত নতুন নতুন সূত্র ও তত্ত্ব শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে উন্নত ও যুগোপযোগী করা হয়।

(vii) আচরণমূলক বিজ্ঞান: আমরা কখন, কেন, কীভাবে আচরণ করি তা নির্ণয় করে মনোবিজ্ঞান এবং শিক্ষা হল আচরণের ব্যাবহারিক দিক।

(viii) সমন্বিত রূপ : সাধারণ মনোবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃ-বিজ্ঞান, প্রয়োগমূলক মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের একটি সমন্বিত রূপ হল শিক্ষা মনোবিজ্ঞান।

১২। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

শিক্ষা মনোবিদ্যার পদ্ধতিসমূহ

শিক্ষা মনোবিদ্যার নিজস্ব কতকগুলি পদ্ধতি আছে, যার দ্বারা আমরা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যে- কোনো শিক্ষার্থীদের আচরণ অনুশীলন করি। শিক্ষা মনোবিদ্যার পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে উল্লেখ করা হল-

(i) অন্তর্দর্শন (Introspection): শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের এই পদ্ধতিটির মাধ্যমে কোনো একজন ব্যক্তি তার নিজের অনুভূতি, প্রেষণা, চিন্তা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াগুলিকে পরীক্ষা করার নিজস্বতা অন্তর্দর্শনের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়।

(ii) পর্যবেক্ষণ (Observation): কোনো অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি যখন কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীর শিক্ষাকালীন আচরণ প্রত্যক্ষণ করেন এবং মন্তব্য করেন, তখন তাকে বলে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি। যেমন- শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষার্থীর আচরণ শিক্ষক এবং অন্যান্য সহপাঠীরা পর্যবেক্ষণ করে থাকে।

(iii) পরীক্ষামূলক পদ্ধতি (Experimental Method): মানব আচরণকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে অধ্যয়ন করার জন্য মনস্তত্ত্ববিদদের নিরন্তর প্রয়াসের ফলই হল পরীক্ষামূলক পদ্ধতি। পরীক্ষামূলক পদ্ধতি হল সবচেয়ে নিখুঁত, পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক। কেবলমাত্র পরীক্ষার সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ, উপাদানের পরিবর্তন, সঠিক অনুমানের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পরীক্ষামূলক পদ্ধতির আবার দুটি ভাগ আছে। যথা-

  1. একদল নকশা: এখানে একটি দলের সাপেক্ষে পরীক্ষণ নকশা তৈরি করা হয়।
  2. সমদল নকশা: এক্ষেত্রে দুটি একরকম দল বাছাই করা হয়। এক্ষেত্রে যে দলের উপর পূর্ব নির্দিষ্ট অভীক্ষা প্রয়োগ করা হয়, তাকে পরীক্ষণমূলক দল, অপরপক্ষে দ্বিতীয় দল যার উপর অভীক্ষা প্রয়োগ করা হবে না, তাকে নিয়ন্ত্রিত দল বলে।

(iv) চিকিৎসামূলক পদ্ধতি (Clinical Method): মানসিক সমস্যাগ্রস্থ শিক্ষার্থীকে বিস্তৃতভাবে অধ্যয়ন করার জন্য শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে এই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চিকিৎসামূলক পদ্ধতি সাধারণত ব্যবহৃত হয় অপসংগতিমূলক এবং ব্যতিক্রমী শিক্ষার্থীদের আচরণ সম্পর্কিত সমস্যার তথ্যসংগ্রহে।

(v) তুলনামূলক পদ্ধতি (Comparative Method): এই পদ্ধতির সাহায্যে শিক্ষার্থীর বর্তমান ও অতীত আচরণের মধ্যে তুলনা করা হয় এবং আচরণের মান ব্যাখ্যা করা হয়।

(vi) কেস স্টাডি (Case Study) পদ্ধতি: অপসংগতিমূলক শিশুদের আচরণের কারণ জানতে তার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করতে এবং সঠিক নির্দেশনার মাধ্যমে শিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে কেস স্টাডি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

(vii) সমাজমিতি (Sociometry) পদ্ধতি: সমাজমিতি পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো দলের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতির আবিষ্কর্তা হলেন ড. জে এল মোরেনো (Dr. JL Moreno)।

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য পদ্ধতিগুলি হল-

(viii) রাশিবিজ্ঞানগত পদ্ধতি: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে যেমন- অভীক্ষাপত্র রচনা, অভীক্ষা গ্রহণ, তথ্যসংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ প্রভৃতি। ক্ষেত্রে রাশিবিজ্ঞানের পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শিক্ষার মূল্যায়নে এই। পদ্ধতি নানাভাবে সাহায্য করে।

(ix) ক্রমবিকাশমূলক পদ্ধতি: দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে শিক্ষার্থীর ধারাবাহিক বিকাশ সম্পর্কে অবহিত হতে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত। হয়। দুইভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। লম্বালম্বিভাবে (Longitudinal) এবং আড়াআড়িভাবে (Cross sectional)। লম্বালম্বির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট শিশুকে দীর্ঘসময় পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং আড়াআড়িভাবে বিভিন্ন বয়সের শিশুদের একই সময়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

(x) অন্তঃক্রিয়া বিশ্লেষণ পদ্ধতি: বর্তমান সময়ে শ্রেণিশিক্ষণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কী পরিমাণে শিক্ষা ও শিখন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে, কোন্ পক্ষ কতক্ষণ কথা বলেনি প্রভৃতি জানার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতির সাহায্যে সংগৃহীত তথ্য থেকে শ্রেণিকক্ষের আবহাওয়া,। শিক্ষণ প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক না পক্ষপাতিত্ব যুক্ত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

(xi) নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণ: অন্য ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তন বাইরে থেকে লক্ষ করে অনুশীলন করার পদ্ধতিই হল নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণ। এই পদ্ধতির উন্নতিসাধনের জন্য বিভিন্ন কৌশল রয়েছে, যেমন- রেটিং স্কেল, ইন্টারভিউ, অ্যানাকডোটাল রেকর্ড, প্রশ্নগুচ্ছ, অভীক্ষা ইত্যাদি। এই পদ্ধতি অনেক নির্ভরযোগ্য।

১৩। শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকের উপর মনোবিজ্ঞানের প্রভাব আলোচনা করে, শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করো।

মনোবিদ্যা ও শিক্ষার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান। বস্তুতপক্ষে শিক্ষা যেমন মনোবিদ্যার উপর নির্ভরশীল, মনোবিদ্যাও তেমনই শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। শিক্ষা, মনোবিদ্যা থেকে প্রাপ্ত আচরণের সাধারণ সূত্রগুলি গ্রহণ করে আচরণের পরিবর্তন ঘটায়। অন্যদিকে, মনোবিদ্যার সূত্রগুলির যথার্থতা যাচাই হয় শিক্ষার মাধ্যমে। উভয়েরই উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর আচরণের পরিবর্তন করা। এদিক থেকে বিচার করলে শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকের উপর মনোবিদ্যার প্রভাব দেখা যায়।

শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকের উপর মনোবিজ্ঞানের প্রভাব

(i) মনোবিদ্যা এবং শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করা এবং তাকে বাস্তবে প্রয়োগ ঘটানো মনোবিদ্যার কাজ। বর্তমান শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর জীবনের সার্বিক বিকাশসাধন করা। অন্যদিকে, মনোবিদ্যার কাজ হল মানবজীবনের বিকাশের ধারাকে অনুশীলন করা। অতএব, মনোবিদ্যা এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং উভয়েরই আলোচ্য বিষয়বস্তু মানবজীবনের বিকাশের অনুশীলন।

(ii) মনোবিদ্যা ও শিক্ষাপদ্ধতি: মনোবিদ্যা যেহেতু শিক্ষার্থীর মানসিক সক্ষমতাকে বিশ্লেষণ করে, সেহেতু শিক্ষার্থীর মানসিক সক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষাপদ্ধতি প্রণয়নে মনোবিদ্যা সাহায্য করে। যেমন- কিন্ডারগার্টেন শিক্ষণ পদ্ধতি, মন্তেসরি শিক্ষণ পদ্ধতি, প্রোজেক্ট পদ্ধতি ইত্যাদি মনোবিজ্ঞানের ফল।

(iii) মনোবিদ্যা ও ব্যক্তিবৈষম্য: শিক্ষার্থীর ব্যক্তিবৈষম্য অনুযায়ী তার নিজস্ব সক্ষমতা, চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার কাজে মনোবিদ্যা সহায়তা করে।

(iv) বিদ্যালয় পরিবেশ ও মনোবিজ্ঞান: আদর্শ বিদ্যালয় পরিবেশ রচনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মনোবিজ্ঞান সরবরাহ করে থাকে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান যথেষ্ট কার্যকরী।

(v) বিকাশের বৈশিষ্ট্য ও মনোবিজ্ঞান: বিভিন্ন বয়সে শিক্ষার্থীর বিকাশের বৈশিষ্ট্য বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। এই সমস্ত বিষয় সম্পর্কে জানতে মনোবিজ্ঞান শিক্ষককে সহায়তা করে।

(vi) মূল্যায়ন ও মনোবিদ্যা: শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার মূল্যায়ন করতে যে অভীক্ষাপত্র ব্যবহার করতে হয়, তা রচনা করার সময় মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান শিক্ষক মহাশয়কে ভীষণভাবে সহায়তা করে।

(vii) ব্যতিক্রমী শিশুদের শিক্ষা নির্দেশনা ও মনোবিজ্ঞান: ব্যতিক্রমী শিশুদের সমস্যা বুঝে উপযুক্ত শিক্ষা নির্দেশনার দ্বারা তাদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে মনোবিজ্ঞান সহায়তা করে।

অতএব, তাত্ত্বিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মনোবিদ্যা এবং শিক্ষার পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।

শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকের উপর মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য প্রভাবগুলি হল-

(viii) মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোবিজ্ঞান: মানসিক স্বাস্থ্য কী, কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য কীভাবে শিক্ষার উপর প্রভাব বিস্তার করে-এসবই মনোবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়।

(ix) দলীয় গতিশীলতা ও মনোবিজ্ঞান: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধ হয়ে শিক্ষক মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে পাঠ গ্রহণ করে। তাই শিক্ষককে অবশ্যই এই দলীয় গতিশীলতা সম্পর্কে ধারণার অধিকারী হতে হবে-যা মনোবিজ্ঞান সরবরাহ করে।

(x) পাঠক্রম: আধুনিক শিক্ষায় পাঠক্রম রচনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিকতার বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখতে হলে শিক্ষার্থীর আগ্রহ, চাহিদা, বয়স ইত্যাদির উপর। গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে। আবার শিক্ষা হবে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিকাশের উপযোগী অর্থাৎ পাঠক্রম কেবলমাত্র বৌদ্ধিক বিকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এই বহুমুখী পাঠক্রমের ধারণার জন্য প্রয়োজন মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য মনোবৈজ্ঞানিক বিভিন্ন দিক যেমন- বুদ্ধি, আগ্রহ, সৃজনশীলতা, ব্যক্তিত্ব, মনোভাব ইত্যাদি শিক্ষার্থীর মধ্যে গঠন করা দরকার। তাই শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক অতি গভীর।

(xi) শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: প্রাচীন কালের শিক্ষক ও আধুনিক শিক্ষকের ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। এর জন্য প্রয়োজন মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান। প্রাচীন কালের শিক্ষক ছিলেন বক্তা এবং তাঁর বক্তব্য শিক্ষার্থীকে শুনতে হত কিন্তু । বর্তমানে সক্রিয়তাভিত্তিক মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষক হবেন পথ প্রদর্শক, সাহায্যকারী, অপরপক্ষে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধারণা সক্রিয়তার মাধ্যমে শিখবে।

১৪। ব্যাবহারিক দিকের উপর মনোবিজ্ঞানের প্রভাব আলোচনা করে, শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করো।

শিক্ষার ব্যাবহারিক দিকের উপর মনোবিদ্যার প্রভাব: শিক্ষা মনোবিদ্যার বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলেই শিক্ষার ব্যাবহারিক দিকের ক্ষেত্রে মনোবিদ্যার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক উপলব্ধি করা যায়। যেমন-

(i) মনোবিদ্যা ও শৃঙ্খলার প্রয়োগ: শিক্ষার্থী নিজেই নিজের শৃঙ্খলায় পরিচালিত হবে এবং স্ব-আগ্রহেই শিক্ষা গ্রহণ করবে। শৃঙ্খলার এই দৃষ্টিভঙ্গি মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে।

(ii) মনোবিদ্যা ও শিক্ষা প্রশাসন: বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে শিক্ষা প্রশাসনকে পরিচালনা করা হয়, যাতে শিক্ষার পরিবেশ সুনিয়ন্ত্রিত থাকে।

(iii) শিক্ষাসহায়ক উপকরণ ও মনোবিজ্ঞান: কোনো জ্ঞান অর্জনের জন্য যদি একাধিক ইন্দ্রিয় ব্যবহার করা হয়, তাহলে অর্জিত জ্ঞান স্থায়ী হয়। মনোবিজ্ঞানের এই নীতি প্রয়োগ করে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষাসহায়ক উপকরণ তৈরি করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণ সহজ হয়।

(iv) সময়তালিকা ও মনোবিজ্ঞান: সময়তালিকা হল একটি সময়ের চার্ট। যেখান থেকে শিক্ষক মহাশয়গণ জানতে পারেন কখন, কোথায় তাঁকে যেতে হবে। এই সময়তালিকা তৈরি করতে গেলে অবশ্যই মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা দরকার। পঠনপাঠনের সময় কীভাবে বিন্যস্ত হবে, কখন টিফিনের সময় হবে, কখন কোন্ পাঠ্য বিষয়ে পাঠদান করা হবে-এসব প্রশ্নের উত্তর মনোবিজ্ঞানই দিয়ে থাকে।

(v) সাপ্তাহিক রুটিন প্রস্তুতি ও মনোবিজ্ঞান: রুটিন তৈরি করার ক্ষেত্রে পরপর কী কী ক্লাস হওয়া উচিত অর্থাৎ কী ক্রম হলে ভালো হয় এই সবকিছু মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

(vi) পাঠ্যপুস্তক রচনা ও মনোবিজ্ঞান: পাঠ্যপুস্তক রচনা করার সময় শিক্ষার্থীর বয়স, পরিণমনের স্তর, আগ্রহ, মানসিক ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতি নজর দিতে হয়- যা মনোবিজ্ঞানের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়।

(vii) সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি ও মনোবিজ্ঞান: শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ। অর্থাৎ বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক, দৈহিক, সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক প্রভৃতি দিকের বিকাশই হল শিক্ষার লক্ষ্য। উপযুক্ত সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর উক্ত বিকাশগুলি সম্পন্ন হওয়া সম্ভব। কোন্ কোন্ ধরনের সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি কোন্ কোন্ ধরনের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম, তা জানতে মনোবিজ্ঞান সহায়তা করে। খেলাধুলো, গানবাজনা, অঙ্কন, বির্তক প্রভৃতি হল সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি যা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

(viii) শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমস্যা ও মনোবিজ্ঞান: শ্রেণিকক্ষে প্রায়ই শিক্ষক- শিক্ষার্থী সমস্যা লক্ষ করা যায়। মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষক মহাশয় এইসব সমস্যার সমাধান করবেন। অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বিশৃঙ্খল আচরণ সমাধান করতে গেলে শিক্ষক মহাশয়কে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে।

অতএব, ব্যাবহারিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মনোবিদ্যা এবং শিক্ষার পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনাসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় শিক্ষাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক অতি গভীর, শিক্ষার অন্যতম ভিত্তি হল মনোবিজ্ঞান। শিক্ষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিককে সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করে তুলতে হলে মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। বর্তমানে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের প্রয়োগে শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা উপলব্ধি ও তার সমাধানের পথ নির্ণয় করে সেগুলিকে মনোবিজ্ঞানসম্মত করার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানসম্মত বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে।

(ix) বিদ্যালয় পরিকল্পনা ও মনোবিজ্ঞান : একদিকে যেমন দিনের কোন্ সময়ে শিক্ষার্থীদের একাগ্রতা, কর্মদক্ষতা অধিক থাকে, কোন্ কোন্ পিরিয়ডে কোন্ কোন্ বিষয় পড়ানো যুক্তিসঙ্গত তা মনোবিজ্ঞান স্থির করে, ঠিক তেমনই শিক্ষালয়ের সমস্ত বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক যে দায়িত্ব পালন করতে হয় সেখানেও মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য সমাজ মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া হয়।

(x) গণতান্ত্রিক প্রশাসন ও মনোবিজ্ঞান: গণতান্ত্রিক প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য হল। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রতিষ্ঠানের সমস্ত কর্মীদের উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন,। সকলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি। বিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে মনোবিজ্ঞানের সহায়তা প্রয়োজন হয়।

(xi) নতুন চিন্তাধারা ও মনোবিজ্ঞান: গবেষণার ফলে উদ্ভাসিত যেসব নতুন নতুন চিন্তাধারা শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, যেমন- গ্রেডিং পদ্ধতি, স্বয়ং শিখন, মুক্ত শৃঙ্খলা, প্রোগ্রাম শিখন পদ্ধতি ইত্যাদি-তার মূলে রয়েছে মনোবিজ্ঞান।

(xii) শিক্ষাগত নির্দেশনা ও পরামর্শদান: কোনো শিক্ষার্থী কোন্ বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করলে সে সাফল্যলাভ করবে তার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশদানই হল | শিক্ষাগত নির্দেশনা। এই নির্দেশনা দেওয়ার জন্য শিক্ষকের এই বিষয়ে উপযুক্ত মনোবিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান থাকা দরকার। শিক্ষকের উপযুক্ত নির্দেশনা ও পরামর্শদান একজন শিক্ষার্থীকে উপযুক্ত বিষয় নির্বাচনে পথ দেখাতে পারবে।

১৫। মনোবিজ্ঞানী স্কিনার প্রদত্ত শিক্ষার ব্যাবহারিক মনোবিজ্ঞানের প্রভাব লেখো।

স্কিনার প্রদত্ত শিক্ষার ব্যাবহারিক দিকে মনোবিজ্ঞানের প্রভাব

মনোবিদ স্কিনার-এর মতে, শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকে যেমন মনোবিজ্ঞানের প্রভাব রয়েছে, তেমনই শিক্ষার ব্যাবহারিক দিকেও মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান।

(i) শিক্ষার বাস্তবমুখীকরণ: শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় হল পাঠক্রম। আর মনোবিজ্ঞানসম্মত পাঠক্রমের উপর ভর করে শিক্ষা তার বাস্তবধর্মী লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে।

(ii) শিক্ষার্থীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের অপসংগতিমূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণ বা দূর করার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের বিশেষ প্রয়োজন। মনোবিদ্যার নানারকম কৌশল ও পদ্ধতির দ্বারা শিক্ষার্থীদের এই অপসংগতিমূলক আচরণ দূর করা সম্ভব হয়েছে।

(iii) বিষয়বস্তু নির্বাচন ও উপস্থাপন: শিক্ষার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে উপযুক্ত বিষয়বস্তু নির্বাচন ও যথাযথ উপস্থাপনের উপর। পাঠক্রমের মধ্যে কোন্ বিষয়কে স্থান দিতে হবে এবং কোন্ বিষয়কে কীভাবে উপস্থাপন করলে শিক্ষার্থী সহজেই তা গ্রহণ করতে পারবে, সবই নির্ভর করে মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের উপর।

(iv) বিদ্যালয় সংগঠন ও পরিচালনা: বর্তমানে বিদ্যালয় পরিচালনা, বিদ্যালয় সংগঠন এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনা করার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। সাপ্তাহিক রুটিন প্রস্তুত, সময় তালিকা প্রস্তুত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা, অভিভাবক-শিক্ষক সম্পর্ক স্থাপন, শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি কাজগুলি করার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের সাহায্য অপরিহার্য।

(v) শিক্ষককে পরামর্শদান: আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী সম্পর্কে সম্যক ধারণা দানের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান শিক্ষকের পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

(vi) শিক্ষার আদর্শ সম্পর্কে সচেতনতা দান: শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের শিক্ষার আদর্শ সম্পর্কে সচেতনতা দান মনোবিজ্ঞানের একটি বিশাল দায়িত্ব।

(vii) শিক্ষার্থী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ: আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার লক্ষ্য হল-“শিশুর জন্য শিক্ষা, শিক্ষার জন্য শিশু নয়।” তাই শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্বাচিত হয় শিক্ষার্থীর আগ্রহ, চাহিদা, সামর্থ্য, পরিণমন প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে, এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান সাহায্য করে।

ভিজিট করুন – www.wbhsnote.com

Leave a Comment