বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো

বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো

বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো
বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো

“বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল- পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান”-রাজপথে মিছিলের কন্ঠে শোনা গেল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গান। 16 অক্টোবর, 1905 খ্রিস্টাব্দ যে দিনটিতে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার কথা, সেই দিনেই হল রাখিবন্ধন উৎসব। তার আগে ওই সালেরই 7 আগস্ট কলকাতার টাউন হলে মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সভানেতৃত্বে জনাকীর্ণ সভায় ঘোষণা করা হল- ইংরেজ শাসন ও আইন আদালত, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা এবং সর্বোপরি বিলেতি পণ্য বর্জন করা হবে, যাকে ‘ত্রিধারা বয়কট’ বা Triple Boycott বলা হয়। সরকারি স্কুল-কলেজ বর্জন করার কথা যখন শুরু হল, তখন বর্জনকারীদের উপর সরকারি পীড়ন শুরু হওয়া কিংবা পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে এল ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’ তথা স্বদেশি শিক্ষা। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারতে যে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার মূল কারণ হল শিক্ষা সম্পর্কে গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এতদিন পর্যন্ত ভারতে দেশীয় সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, কিন্তু ইংরেজরা এদেশের শাসনভার গ্রহণ করার পরে যে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হল, তার সঙ্গে ভারতীয় শিক্ষা সংস্কৃতির সংঘাত ঘটে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কিছু আত্মসচেতন শিক্ষিত ভারতীয় নাগরিক এ ব্যাপারে সচেতন হন এবং দেশীয় শিক্ষার পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেন। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নেতারা আবেদন-নিবেদন নীতির মাধ্যমে শিক্ষা সংস্কারের দাবি তোলেন। কিন্তু তা কার্যকরী না হওয়ায় নেতারা জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ ও অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের কয়েকটি মূল কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে-

(1) ভারতীয় মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত দেশের তথাকথিত জনগণ ক্রমশই উপলব্ধি করছিলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা তাদের আত্মিক উন্নতিতে সহায়তা করতে পারছে না। ভারতীয় সংস্কৃতি ও জীবনাদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জাতীয় আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না। ভারতীয় মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের।

(2) শিক্ষণ পদ্ধতির পরিবর্তন ও প্রচেষ্টা

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের নেতৃবর্গ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষণ পদ্ধতির ত্রুটি নিয়ে ক্রমশই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। এগুলি দূর করার জন্য কিছু কিছু চিন্তাবিদ একক প্রচেষ্টায় বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে। যেমন- 1895 সালে কলিকাতার ভবানীপুরে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ভাগবত চতুষ্পাঠী নামে এক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ সেজন্য বোলপুরে শান্তিনিকেতনে 1901 সালে স্থাপন করেন ব্রহ্মচর্য আশ্রম। দেশের শিশুদের শিক্ষার এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ এবং সতীশচন্দ্র উভয়েই জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

(3) নৈতিক মান উন্নয়নের প্রচেষ্টা

জাতীয় নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিদের নৈতিক মানের অবনতি ঘটাচ্ছে। ইংরেজি জানা ব্যক্তিরা একটি বিশেষ শ্রেণি হিসেবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতেন। তাদের মূল্যবোধ বিদেশি সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাধারণ মানুষের মূল্যবোধে আঘাত হানত। তাই নেতারা ভেবেছিলেন শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক উপাদান যুক্ত হলে, এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। তাই জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের এটি একটি অন্যতম কারণ।

(4) শিক্ষার মাধ্যম পরিবর্তনের চেষ্টা

ইংরেজরা এদেশে আসার পর ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিষয়বস্তু আয়ত্ত করা দুরূহ হয়ে যাচ্ছিল এবং তারা শিক্ষার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ছিল। এতে গণশিক্ষার প্রসার ব্যাহত হচ্ছিল। তাই জাতীয় নেতৃবর্গ মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার দাবি জানাচ্ছিলেন। জাতীয় আন্দোলনের এটি একটি কারণ।

(5) ব্যাবহারিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা

ইংরেজদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল দেশের কিছু মানুষকে কেরানিগিরির জন্য পুঁথিসর্বস্ব শিক্ষা। ব্যাবহারিক শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা এখানে ছিল না। ফলে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং যুবসমাজের মনে অসন্তোষ জমা হচ্ছিল। কারিগরি ও বৃত্তিশিক্ষার প্রবর্তনের জন্য ভারতীয় শিক্ষাবিদগণ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানাচ্ছিলেন। তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি ব্যাবহারিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা জাতীয় আন্দোলনের আর একটি কারণ।

(6) কার্নাইল সার্কুলার / স্বদেশি-বিরোধী সার্কুলার

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মফঃস্বলের প্রধান শিক্ষকদের কাছে নির্দেশ পাঠান-

  1.  সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কোনো স্কুলের ছাত্ররা সরকারবিরোধী কোনো কাজ করবে না।
  2.  যেসব স্কুলে সরকারবিরোধী কোনো কাজ হবে, সেই স্কুলগুলি সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে এবং ছাত্ররাও বৃত্তি পাবে না।
  3. সেইরূপ স্কুলগুলির স্বীকৃতি বাতিল হবে।
  4.  ছাত্ররা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে, তাদের অপরাধী বলে ছাত্রদের একটি তালিকা পেশ করবে স্কুল।
  5.  শিক্ষক এবং স্কুল পরিদর্শকদের বিশেষ পুলিশ হিসেবে কাজ করে ছাত্রদের পাহারা দিতে হবে। এটি ছিল স্বদেশি-বিরোধী সার্কুলার।

(7) শিক্ষার ব্যাপারে স্বাধিকারবোধ প্রতিষ্ঠা

1901 সালে তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য সিমলা সম্মেলন আহ্বান করেন এবং 1902 সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করেন। কোনো ভারতীয়কে এই সম্মেলনে আহ্বান করা হয়নি, আবার বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনেও কোনো ভারতীয় সদস্য রাখা হয়নি। এই দুই ঘটনা ভারতীয়দের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। পরে অবশ্য জনমতের চাপে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনে দুজন ভারতীয়কে সদস্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। তরী বেগপাইতা

(৪) শিক্ষা সংকোচনের প্রতিবাদ

লর্ড কার্জন 1904 সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করেন। তাতে সর্বক্ষেত্রে সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতি জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বন্ধ করা হয়, কলেজ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি অনুমোদনের ব্যাপারে কঠোর নিয়মাবলি গ্রহণ করা হয়। দেশের সকল শিক্ষাবিদ এই মনোভাবের প্রতিবাদ করে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন।

(9) বঙ্গভঙ্গ রদ

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনকে পঙ্গু করার জন্য লর্ড কার্জন জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রস্থল বঙ্গদেশকে ভেঙে ফেলার প্রস্তাব দেন। দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের এটি একটি প্রধান কারণ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভারতে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন কোনো একটি বিশেষ কারণে নয়, অনেকগুলি কারণ একত্রে মিলিত হয়ে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment