প্রাথমিক শিক্ষাসংক্রান্ত হার্টগ কমিটির সুপারিশগুলি আলোচনা করো

“জানিতে চাহ মাপিয়া দেখ। গড়াইছে কতদূর” – মেপে না চলার ফল ভয়ানক হতে পারে। অর্থবান অর্থহারা হতে পারে, শক্তিমান হেরেও যেতে পারে; মেপে না চলে রাবণ সীতা হরণ করার ফল কী হয়েছিল আমরা সবাই জানি। ইংরেজ সরকার মেপে দেখতে চেয়েছিল; শিক্ষার অগ্রগতি ঠিক কতটা। বুঝে সমঝে নেওয়ার জন্য তাই আস্ত একটা কমিটি তারা গঠন করে ফেলে- হার্টগ কমিটি 19291 মন্টেগু চেম্সফোর্ড সংস্কার বিধিবদ্ধ হবার পর সময় স্থির হয়েছিল এই সংস্কার কতটা সফল, তা তদন্তের জন্য দশ বছর পরে একটি রয়েল কমিশন বসবে।
কিন্তু দেশব্যাপী আন্দোলন ও বিক্ষোভের ফলে 1927 খ্রিস্টাব্দে স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে এক কমিশন নিয়োগ করা হয়। ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষার অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে তদন্ত করে রিপোর্ট পেশ করার জন্য সাইমন কমিশন 1928 খ্রিস্টাব্দে স্যার ফিলিপ হার্টগের সভাপতিত্বে এক উপসমিতি নিয়োগ করেন (Auxiliary Committee of the Indian Statutory Commission) এবং ভারতের শিক্ষার বিভিন্ন দিক তদন্ত করে 1929 খ্রিস্টাব্দে এক রিপোর্ট পেশ করেন। এই রিপোর্ট ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে ‘হার্টগ রিপোর্ট’ নামে পরিচিত।
প্রাথমিক শিক্ষার ত্রুটির কারণ ও ত্রুটি দূরীকরণের প্রস্তাবসমূহ
শিক্ষা সম্পর্কে দেশব্যাপী ব্যাপক আগ্রহ সত্ত্বেও গণশিক্ষার অগ্রগতি আশানুরূপ নয় বলে কমিটি মন্তব্য করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষার যে সকল ত্রুটিগুলি কমিটি বলেছেন তা হল-
(1) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও গণশিক্ষার প্রসার হয়নি।
(2) উচ্চশিক্ষার তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষায় উৎসাহ কম দেখানো হয়েছে।
(3) গ্রামের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবি হওয়ায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন নয়।
(4) পথঘাটের অভাব, যাতায়াতের অসুবিধা, অর্থনৈতিক দূরাবস্থা, অজ্ঞতা, সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িক মনোভাব, জাতিভেদ প্রথা ইত্যাদি গণশিক্ষার পথে অন্যতম অন্তরায়।
(5) অপচয় (Wastage) ও অনুন্নয়ন (Stagnation) হল অন্যতম কারণ। এর ফলে সময়, শ্রম ও অর্থের বিপুল অপচয় ঘটে।
প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশ
(1) বৈতনিক ও বাধ্যতামূলক: প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে সমস্ত শিক্ষার্থীকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
(2) শিক্ষক-শিক্ষণ: প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষক- শিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাঠরত শিক্ষকদের রিফ্রেশার কোর্স এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে শিক্ষকদের মান বাড়ানো সম্ভব হবে।
(3) মহিলা শিক্ষক নিয়োগ: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মহিলা শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।
(4) তত্ত্বাবধান: কমিশন সুপারিশ করে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধান এবং পরিচালনা সরকারের অধীনে হওয়ায় উচিত।
(5) গ্রামীণ রূপান্তর: গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই স্তরের পাঠক্রম রচিত হবে, পাঠক্রম সহজ, সরল ও গ্রাম্য জীবনের উপযোগী হবে।
(6) বিনোদন: কমিটি এই স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনোদনমূলক দিকের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। যাতে এখানে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে।
(7) গুণগত মানোন্নয়ন: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শুধুমাত্র সংখ্যা না বাড়িয়ে মানোন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে।
(৪) সময়কাল: প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের সময়কাল হবে অন্তত চার বছরের।
(9) সময় তালিকা: বিদ্যালয়ের অবস্থা এবং পরিবেশের কথা বিবেচনা করে বিদ্যালয়ের সময় তালিকা তৈরি করা দরকার।
(10) অপচয় এ অনুন্নয়ন রোধ: যথা সম্ভব অপচয়, অনুন্নয়ন কমাতে হবে অর্থাৎ কোনো কারণেই যেন কোনো শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয় সে দিকে নজর রাখা দরকার।
(11) গ্রামীণ মঙ্গলের জন্য কেন্দ্র: প্রাথমিক বিদ্যালয় গ্রামীণ বিভিন্ন কেন্দ্র যেমন-গ্রামীণ উন্নয়নমূলক কাজ, স্বাস্থ্য রিলিফ সংক্রান্ত কাজ, বয়স্কশিক্ষা, গণশিক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিনোদনমূলক কাজে বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে।
(12) সরকারি অনুদান : যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয় কর্মসূচি তাই শিক্ষাক্ষেত্র থেকে পুরোপুরি সরকারি অনুদান বন্ধ করা যাবে না। দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্র অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনীয় অনুদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর