প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো

প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি ও উন্নতির ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান অবিস্মরণীয়। 1853 খ্রিস্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্কুল গঠন করা, পাঠ্য বই রচনা করা, শিক্ষক- শিক্ষণের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেই সময় বড়োলাট ডালহৌসি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সুপারিশগুলি সমর্থন করেছেন।
(1) শিক্ষার মাধ্যম
স্কুলগুলিতে মাতৃভাষার (বাংলা) মাধ্যমে পড়ানোর কথা বলেছেন।
(2) পাঠ্যসূচি
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে পাঠক্রমে থাকবে লেখাপড়া ও গণিতের হিসাব, ভূগোল, ইতিহাস, পাটিগণিত, প্রকৃতি বিজ্ঞান, শারীর তত্ত্ব ইত্যাদি।
(3) মডেল স্কুল
বিদ্যাসাগর প্রত্যেকটি জেলায় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিযুক্ত মডেল স্কুল স্থাপন করার কথা বলেছেন। প্রত্যেক স্কুলে একজন প্রধান পণ্ডিত ও 2 জন সহকারী প্রধান পণ্ডিত থাকবেন।
(4) পরিদর্শন ব্যবস্থা
2 টি করে জেলায় একজন করে পরিদর্শক থাকবেন। তারাই বিদ্যালয়গুলির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন।
(5) শিক্ষক-শিক্ষণ
শিক্ষক-শিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল স্থাপনের কথা বলেছেন।
(6) পণ্ডিতদের বেতন
গুণ ও যোগ্যতা অনুসারে পণ্ডিতদের বেতন কমপক্ষে কুড়ি থেকে ত্রিশ টাকা হওয়া দরকার। আর প্রধান পণ্ডিতেরা কমপক্ষে 50 টাকা বেতনে নিযুক্ত হবেন।
(7) জেলাভিত্তিক বিদ্যালয় স্থাপন
প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের জন্য প্রথম ধাপে হুগলি, নদিয়া, বর্ধমান ও মেদিনীপুর এই চারটি জেলা নির্বাচন করা হয়। পঞ্চাশটি বিদ্যালয় প্রয়োজন অনুসারে এই চারটি জেলায় ভাগ হবে। বাংলা শিক্ষার কদর যাতে নষ্ট না হয় সে কারণে কোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা কলেজের আশেপাশে এগুলি স্থাপিত হবে না।
(৪) পরিদর্শক নিয়োগ
যাতায়াতের ব্যয় সমেত মাসিক 150 টাকা বেতনে দুজন বাঙালি পরিদর্শক নিয়োগের কথা বলা হয়, মেদিনীপুর ও হুগলির জন্য একজন, বর্ধমান ও নদিয়ার জন্য অন্যজন। তাদের কার্যধারার মধ্যে থাকবে ঘনঘন বিদ্যালয় পরিদর্শন, প্রত্যেক শ্রেণির ছাত্রদের পরীক্ষা গ্রহণ ও প্রয়োজনমতো শিক্ষাপ্রণালীর সংস্কার করা।
(9) প্রধান পরিদর্শক নিয়োগ
বিনা পারিশ্রমিকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষই প্রধান পরিদর্শক নিযুক্ত হবেন এবং বিদ্যালয়গুলির পরিচালনার ভার কর্তৃপক্ষের উপরই ন্যস্ত থাকবে।
(10) প্রশাসনিক সার্কেল প্রথা চালু
বিদ্যালয়গুলির সুস্থ প্রশাসনের উদ্দেশ্যে সার্কেল প্রথা চালু হয়। বিদ্যাসাগর দক্ষিণ বাংলা সার্কেলের পরিদর্শক নিযুক্ত হন এবং তাঁর এলাকার প্রতিটি জেলায় পাঁচটি করে বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
(11) শিশুদের জন্য পুস্তক রচনা
শিশুদের জন্য বিদ্যাসাগর রচিত উল্লেখযোগ্য পুস্তকগুলি হল- বর্ণপরিচয়, পন্থাবলি, (জীবজন্তুর বিবরণী), বাংলার ইতিহাস, চারুপাঠ, জীবনচরিত প্রভৃতি।
বর্ণপরিচয় প্রথম প্রকাশিত হয় 1855 সালে, এ ছাড়াও শিশুদের জন্য। বিদ্যাসাগর আরও যে-সমস্ত বইগুলি লেখেন, সেগুলি হল- বোধোদয়, ঋজুপাঠ, ঈশপ ফেবলস থেকেও নির্বাচন করা কাহিনি নিয়ে সরল ভাষায় কথামালা লিখেছিলেন। তা ছাড়া বাংলা ভাষায় নীতি-উপদেশ পরিবেশন করার জন্য তিনি আখ্যান মঞ্জুরী নামে একটি বইও লেখেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই সমস্ত সুপারিশ বড়োলাট ডালহৌসি এবং হ্যালিডে সাহেবের কাছে পাঠালে তারা অনুমোদন দেয়, হুগলি, মেদিনীপুর, নদিয়া, বর্ধমান জেলায় 20টি বিদ্যালয় তৈরি হয়।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর