প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে হান্টার কমিশনের শিক্ষানীতি বিষয়ক এবং প্রশাসন বিষয়ক সুপারিশগুলি লেখো। এই কমিশনের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত সুপারিশগুলির মূল্যায়ন করো

প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে হান্টার কমিশনের শিক্ষানীতি বিষয়ক সুপারিশসমূহ
(1) কমিশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের কথা বলা হয়।
(2) নৈতিক, সৎ ও আদর্শপরায়ণ মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা শিক্ষার্থীদের প্রদান করা হবে।
(3) বিভিন্ন জেলায় অনগ্রসরদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ সম্পর্কেও হান্টার কমিশনে সুপারিশ করা হয়।
(4) প্রাথমিক শিক্ষা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাস্তর হিসেবে বিবেচিত হবে।
(5) এ ছাড়া আরও বলা হয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে দেশের জনগণের জন্য ন্যূনতম শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
প্রশাসন বিষয়ক সুপারিশসমূহ
(1) কমিশন উল্লেখ করে যে, দেশে প্রাথমিক শিক্ষাবিস্তার তথা পরিচালনার দায়িত্বভার জেলা বোর্ড বা মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
(2) নিজ নিজ এলাকার জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন যাতে একটি শিক্ষাবোর্ড গঠন করে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গৃহীত হবে।
(3) শিক্ষাবোর্ডগুলি নিজ এলাকার প্রয়োজন বিবেচনা করে নতুন স্কুল স্থাপন করবে বলে উল্লেখ করা হয়।
(4) এ ছাড়া বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য জেলা ও মিউনিসিপ্যাল বোর্ড পৃথক তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেবে।
(5) স্থানীয় এবং প্রাদেশিক রাজস্বের মোট অংশ প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ব্যয়ের কথা বলা হয়।
(6) প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সরকার শিক্ষাখাতের তিন ভাগের এক ভাগ অনুদান মঞ্জুর করবেন বলে হান্টার কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, হান্টার কমিশনের সুপারিশ নানা দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে অনেকক্ষেত্রেই এই সুপারিশগুলি বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভবপর হয়নি। কারণ সুপারিশগুলির কার্যকারিতা সম্পর্কে হান্টার কমিশনে বিশেষ কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে হান্টার কমিশনের রিপোর্ট প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম মহামূল্যবান দলিল এ কথা বলা যায়।
হান্টার কমিশনের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত সুপারিশগুলির মূল্যায়ন
প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ সম্পর্কে হান্টার কমিশনে যেমন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকের উপর আলোকপাত করা হয়েছে, তেমনই এর বিভিন্ন ত্রুটি চোখে পড়ে।
(1) গুরুত্ব :
(1) হান্টার কমিশনে প্রাথমিক শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্তর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, যা সামগ্রিক শিক্ষা কাঠামোর ক্ষেত্রেই ছিল বিশেষ প্রয়োজনীয়।
(2) প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমে বিভিন্ন প্রয়োজনভিত্তিক বিষয় নির্বাচন করে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যা ছিল আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
(3) গণশিক্ষার ভিত্তি রচনা করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। বিশেষত জনকল্যাণের কাজে যাতে এই শিক্ষা ব্যবহৃত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হয়েছিল।
(4) স্বায়ত্তশাসন সংস্থাগুলি তাদের বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকের বেশি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করবে বলে উল্লেখ করা হয়। এই নীতিও ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
(2) ত্রুটি :
(1) প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়নি। এ ছাড়া অর্থসংস্থান সম্পর্কেও এখানে অস্পষ্টতা ছিল।
(2) হান্টার কমিশনে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে অনুকূল অভিমত প্রকাশ করা হলেও সেগুলির উন্নয়নের জন্য কোনো গঠনমূলক পরিকল্পনা ছিল না।
(3) প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে ‘পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অর্থসাহায্য দান’ এই নীতি গৃহীত হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত হওয়ার পরিবর্তে পরীক্ষা-শাসিত শিক্ষার প্রাধান্য ঘটে। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও প্রসার ব্যাহত হয়। পরিশেষে বলা যায়, ভারতে গণশিক্ষার ভিত্তি রচনার জন্য এই কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর