ডাইনিবিদ্যা থেকে সামাজিক মুক্তির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করো
অথবা, ডাকিনীবিদ্যা থেকে সামাজিক বন্ধনমুক্তি কীভাবে সম্ভব হয়েছিল

সুপ্রাচীন কাল থেকে জাদুবিদ্যা বা ডাইনিবিদ্যা বিশ্ব তথা ইউরোপের সমাজজীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। আদিম সমাজে ডাইনিবিদ্যা মানুষের মঙ্গলসাধনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে মানুষ এর অপব্যবহারে মেতে ওঠে। খ্রিস্টান সমাজ অমানবিক ডাইনি-নিধনকে পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করে এবং বিভিন্ন দেশে ডাইনি প্রথাবিরোধী বিভিন্ন আইন পাস হতে থাকে। সর্বোপরি রেনেসাঁ-প্রসূত যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনায় সচেতন মানুষ ডাইনিদের এবং অপরদিকে অভিযুক্ত ডাইনিরাও শতাব্দী প্রাচীন অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির পথ খোঁজে।
ডাইনিবিদ্যা থেকে সামাজিক মুক্তির ইতিহাস
ডাইনিবিদ্যা থেকে সামাজিক মুক্তির ইতিহাস অত্যন্ত জটিল এবং তা ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ডাইনিদের প্রতি বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের প্রক্রিয়া একাধিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সংঘটিত হতে দেখা যায়।
(1) প্রাচীন ও মধ্যযুগ: প্রাচীন ও মধ্যযুগে প্যাগান ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ডাইনিবিদ্যা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। তবে ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্মের উত্থান ঘটলে ডাইনিবিদ্যার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের যুগে সমাজপতিরা ডাইনিদের বিচার ও শাস্তি দিতে শুরু করেন। খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের মদতে মধ্যযুগে ইউরোপ জুড়ে ডাইনিদের পুড়িয়ে মারা-সহ বিভিন্নভাবে হত্যা করা হয়। আসলে, সাধারণ মানুষ ধর্মগুরুদের তত্ত্ব বুঝত না। ধর্মগুরুরা ডাইনিদের শাস্তি দিতেন এবং সাধারণ মানুষকে তাদের থেকে দূরে থাকতে বলতেন। অনেক সময় ডাইনিদের শাস্তি দিয়ে তাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিতও করা হত। এর ফলে খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার ঘটে।
(2) আধুনিক যুগ:
- যুক্তিবাদের প্রসার: মধ্যযুগের ডাইনিপ্রথার তুকতাক, ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র ছিল রেনেসাঁ-প্রসূত ধারণার বিরোধী। নবজাগরণসৃষ্ট যুক্তিবাদ মানুষকে সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শিখিয়েছিল। এই যুক্তিবাদের ফলে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বাধাগুলি ক্রমশ অপসারিত হয় এবং মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। যুক্তি দিয়ে ডাইনিতত্ত্বের উৎস সন্ধানে আগ্রহী হয় তারা। ফলে সমাজে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটে।
- আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসার প্রসার: বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার যত অগ্রগতি হয়েছে তত মানুষের অসুখ-বিসুখে Witch Doctor বা ওঝা-র উপস্থিতি কমেছে। চিকিৎসাবিদ্যায় বিশ্বব্যাপী গবেষণা, নতুন নতুন ওষুধের আবিষ্কার, হাসপাতাল তৈরির পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডাইনি চিকিৎসকের উপর নির্ভরতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ফলে মানুষও হাতুড়ে ডাইনি ডাক্তারদের হাত থেকে মুক্তি পায়।
- ধর্মীয় অবস্থানের পরিবর্তন: অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক থেকে খ্রিস্টান চার্চ ডাইনিবিদ্যার বিষয়ে নতুন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। এই সময় ডাইনি-নিধনের বিরোধিতা করা হয়। পরিবর্তে ডাইনিবিদ্যাকে একটি ভিত্তিহীন কুসংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে ডাইনিবিদ্যা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
- আইনগত পরিবর্তন: অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাইনিবিদ্যার বিরুদ্ধে প্রচলিত কঠোর আইনগুলিকে বাতিল বা সংশোধন করা হয়। ইংল্যান্ড, জার্মানি-সহ ইউরোপের নানা দেশ এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(3) সাম্প্রতিক সময়কাল:
- নারীবাদীদের ভূমিকা: নারীবাদীদের মতে, নারীরা যখনই স্বাবলম্বী ও স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে, তখনই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের শেষ করে দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। পরিবারের অপছন্দের বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্না একা নারীদের করা হয়েছে আক্রমণের লক্ষ্য। বয়স্কা নারীদের সম্পত্তি দখলের লোভে সমাজপতি বা তার প্রতিবেশীরাই তাকে ডাইনি অপবাদে অভিযুক্ত করেছে। আধুনিক যুগে মহিলারা মহিলাদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে, জোট বাঁধছে ও আন্দোলনে শামিলও হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় নারীদের গণবিক্ষোভ প্রদর্শন তারই উদাহরণ। এর বিরুদ্ধে মহিলাদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরির মতো অসাধু উদ্দেশ্যও লক্ষণীয়।
- আন্তর্জাতিক ডাইনি কংগ্রেস: ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক পর্যালোচনায় ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত ডাইনি কংগ্রেস (International Witches’ Congress) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইউরোপীয় ডাইনিদের সমগোত্রীয় ল্যাটিন আমেরিকা ও কানাডার ডাইনিরা মেক্সিকোর এক পাহাড়ে অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেসে বলেছিল, আমাদের দেখাতে হবে যে আমরা বিপজ্জনক নই (… We are not diabolical) I
- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (Amnesty International) ২০০৮ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে উইচ ডক্টর প্রথা বন্ধ করার জন্য প্রচার করে। সেখানে তাদের ফাঁসির নির্দেশ দেওয়া হয়, কারণ- ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে এই উইচ ডক্টরদের নির্দেশে ৪২ জন নারীকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয়েছিল।
- সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ: সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations)-এর ২০১৭ সালের ২১-২২ সেপ্টেম্বর জেনেভায় অনুষ্ঠিত কর্মশালায় আন্তর্জাতিক স্তরে ডাইনিবিদ্যা ও মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। কীভাবে ডাইনি সংক্রান্ত ঘটনার মোকাবিলা করা সম্ভব, রাষ্ট্রীয় আইনকাঠামো দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট কিনা ইত্যাদি ছিল এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু।
- মানবাধিকার কাউন্সিল: ২০২১ সালে জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার কাউন্সিল (Human Rights Council)-এর ৪৭ তম অধিবেশনে ডাইনিবিদ্যা ও আক্রমণের অভিযোগ সম্পর্কিত ক্ষতিকারক দিকগুলি নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মূল্যায়ন
ডাইনিবিদ্যা থেকে সামাজিক মুক্তির প্রক্রিয়া যে অতি দীর্ঘ এবং সময়সাপেক্ষ – তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, মানবাধিকার চেতনা, ধর্মীয় অবস্থানের পরিবর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে আধুনিক সমাজে ডাইনিবিদ্যার চর্চা আংশিক হলেও হ্রাস পেয়েছে। তবে তা সমাজ থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে একথা বলা যায় না। সাম্প্রতিক কালে ইউরোপের অনেক যুবক-যুবতী অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে ডাইনি বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। তারা ধর্মীয় গোঁড়ামি, ভণ্ডামি ও চার্চের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ডাইনি বিদ্যাচর্চায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। প্রচলিত সামাজিক জীবনের বাঁধন ভেঙে ডাইনিবিদ্যার গুপ্ত ক্রিয়াকাণ্ড, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে মেতে উঠছে। শুধু ইউরোপই নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এখনও অতিপ্রাকৃতের চর্চা সমানতালে উপস্থিত।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর