ডন সোসাইটি কে প্রতিষ্ঠা করেন এবং সোসাইটির কী উদ্দেশ্য ছিল

বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, 1902 সালে ‘ডন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর আগে থেকেই ছাত্রদের জাতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজ কর্মীদের প্রচেষ্টা ছাড়াও আরও একজন আদর্শবাদী শিক্ষাবিদ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন। দেশে ইতিহাস, দর্শন, শিল্প সম্পর্কে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়, সতীশচন্দ্র ছিলেন তাঁর অন্যতম পথপ্রদর্শক। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ডন সোসাইটি।
1895 সালে সতীশচন্দ্র ভাগবত চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন। ভাগবত চতুষ্পাঠী হল তাঁর শিক্ষাপ্রচেষ্টা। ভারতীয় দর্শন ও সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষা দেবার জন্য ভবানীপুর অঞ্চলে এই চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন। চতুষ্পাঠী স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিপূর্ণতা আনা, জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা, ছাত্রদের অধ্যাত্ম শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, দর্শন এবং শিল্প ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা। প্রতিষ্ঠানটি ছিল আবাসিক, এখানে পাঠ্য বিষয় ছিল- সাংখ্য, বেদান্ত, ব্রহ্মসূত্র, ন্যায়, স্মৃতি, ইতিহাস ইত্যাদি।
এই চতুষ্পাঠীর মুখপত্র ছিল ডন নামক একটি পত্রিকা। পরিশেষে এই পত্রিকাই হয়েছিল ডন সোসাইটি এবং স্বদেশি আন্দোলনের মুখপত্র। সতীশচন্দ্র ডন পত্রিকার নামানুসারে, ডন সোসাইটি (The Dawn Society) প্রতিষ্ঠা করেন। ডন সোসাইটি প্রতিষ্ঠার কিছু পরেই ভাগবত চতুষ্পাঠী বন্ধ হয়ে যায় এবং 1904 সালে ডন পত্রিকা সোসাইটির মুখপত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। ডন সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ডন সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল-
- দেশের যুব সম্প্রদায়কে শিক্ষাদান করা।
- শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য নৈতিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।
- স্বার্থত্যাগের মহান আদর্শগুলি গ্রহণ করা।
- কলেজের ছাত্রদের মধ্যে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
- ছাত্রদের কারিগরি বিষয়ে শিক্ষাদান করা।
- ছাত্রদের পুঁথিগত শিক্ষায় উন্নতমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করা ও শিক্ষার অব্যবস্থা দূর করা।
- ছাত্রদের স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা প্রভৃতি।
এই সোসাইটিতে নিয়মিত আলোচনাসভা, কথোপকথন, সামাজিক অনুষ্ঠান, নির্বাচিত বই পড়া প্রভৃতির সু-ব্যবস্থা ছিল। ছাত্ররা ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। এতে তাদের চিন্তাশক্তির বিকাশ হত এবং স্বাধীনভাবে সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এইসব কাজ পরিচালনা করতেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। দীনেশচন্দ্র সেন, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখ মনীষীদের বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হত। এ ছাড়া বাইরের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ক্লাস নিতেন এবং বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। এই সোসাইটির উদ্যোগে কলিকাতার শিল্প প্রদর্শনী ও স্বদেশি দোকান প্রতিষ্ঠিত হয়। ডন পত্রিকা নিয়মিত প্রবন্ধ প্রকাশ করে দেশবাসীকে সচেতন করার চেষ্টা করতেন। সমসাময়িক বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রবন্ধও এই পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ পেত।
ভারতের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ডন সোসাইটির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। 1902 সালে লর্ড কার্জনের সমাবর্তন ভাষণের পর ডন পত্রিকায় সতীশচন্দ্রের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির নাম হল- “An examination into the present system of education in India and a scheme of reforms.”
ডন সোসাইটি ছিল সম্পূর্ণ বেসরকারি সংস্থা ও পুরোপুরি ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র প্রতিষ্ঠান। এটি পরিচালিত হত স্বেচ্ছাশ্রমে ও স্বেচ্ছাদানে। এই প্রতিষ্ঠানের দাতাদের মধ্যে ছিলেন স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, ভগিনী নিবেদিতা, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নীলরতন সরকার প্রমুখ ব্যক্তিগণ। এই প্রতিষ্ঠান যুবসম্প্রদায়কে উদ্দীপিত করেছিল। এর সদস্যরা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলেনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বদেশি আন্দোলন ও জাতীয় শিক্ষাবিস্তারে ডন সোসাইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর