জাতীয় শিক্ষা’ বলতে কী বোঝায়? ভারতে জাতীয় শিক্ষা ‘আন্দোলনের পটভূমিটি ব্যাখ্যা করো

জাতীয় শিক্ষা’ বলতে কী বোঝায়? ভারতে জাতীয় শিক্ষা ‘আন্দোলনের পটভূমিটি ব্যাখ্যা করো

জাতীয় শিক্ষা' বলতে কী বোঝায়? ভারতে জাতীয় শিক্ষা 'আন্দোলনের পটভূমিটি ব্যাখ্যা করো
জাতীয় শিক্ষা’ বলতে কী বোঝায়? ভারতে জাতীয় শিক্ষা ‘আন্দোলনের পটভূমিটি ব্যাখ্যা করো

‘বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত যবে উৎপিড়িতের কন্দনরোল। আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না অত্যাচারীর খড়ঙ্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।’-আন্দোলন তখন হয়, মানুষের যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। ইংরেজ নামক শোষক-দানব দেড় শত বছর ধরে ভারতভূমিকে শোষণ করতে থাকে। বদলে ছিটে ফোঁটা দান করে শান্ত রাখতে চেয়েছিল ভারতীয়দের। তাদের সেই কূটনৈতিক কৌশলের অঙ্গ হিসেবে তারা শিক্ষার আঙিনাকে ব্যবহার করে। একের পর এক কমিশন বসিয়ে শিক্ষার উন্নতির নামে ভারতীয়দের চোখে ধুলো দিতে থাকে। সাধারণ মানুষ অচীরেই বুঝল দানবের সঙ্গে সংগ্রামে নামতে হবে, অস্ত্র হবে শিক্ষা আন্দোলন। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন 1905 হল সেই বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি যে শিক্ষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে জাতীয় শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ছিল কি না, তা বিচার করেই তাকে ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’ নামে অভিহিত করা যায়।

জাতীয় শিক্ষা

জাতীয় শিক্ষা বলতে আমরা সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝি, যা ব্যক্তির মধ্যে জাতীয় আদর্শগুলি সংযোজনে সাহায্য করে। তবে এই ধারণায় জাতীয় আদর্শ বা সমাজ আদর্শকে একটি স্থিতিশীল ধারণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় আদর্শকে স্থিতিশীল হিসেবে গণ্য করা হলে, জাতির অগ্রগতিকে অস্বীকার করা হয়। ফলে শিক্ষা স্থিতিশীল যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হয়ে পড়ে। তাই ‘জাতীয় শিক্ষা’ সংক্রান্ত এই ধারণাটিও গ্রহণযোগ্য নয়।

শিক্ষাবিদগণ আর একটি মতবাদে বলেছেন, যে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় লক্ষ্যগুলিতে পৌঁছোতে সহায়তা করে, তাকেই বলা হবে জাতীয় শিক্ষা। প্রত্যেক জাতি বা সমাজের কিছু সাধারণ লক্ষ্য থাকে। সমাজ অন্তর্গত প্রতিটি ব্যক্তি সেগুলি চরিতার্থ করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। সুতরাং এই ধারণা অনুযায়ী, যে শিক্ষাব্যবস্থা সমাজ বা জাতির অন্তর্গত সকল ব্যক্তির মধ্যে জাতীয় লক্ষ্যাভিমুখী আচরণের সহায়তা করে, তাকেই বলা হবে জাতীয় শিক্ষা। এই ধারণাতে কিছু ত্রুটি রয়েছে। কারণ এখানে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যগুলিকে একটি নির্দিষ্ট জাতীয় লক্ষ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।

বিভিন্ন ধারণাগুলি বিশ্লেষণ করে আধুনিক শিক্ষাবিদগণ বলেন, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যা জাতির অন্তর্গত সকল ব্যক্তিকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে, জাতিগত লক্ষ্যগুলিকে সমভাবে প্রত্যক্ষ করার প্রশিক্ষণ দেবে এবং সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যাগুলির সমাধানে তাদের মধ্যে প্রেষণা সঞ্চার করতে পারবে। যেমন- বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জাতীয় নেতারা যে আন্দোলন করেছিলেন, তার জতীয় লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জন।

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের পটভূমি

ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তা দেশীয় সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকার যে শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে প্রবর্তন করেছিলেন তার সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কোনো যোগ ছিল না। আমাদের দেশে টোল, পাঠশালার মধ্য দিয়ে শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, তাকে যুগোপযোগী সংস্কার করে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো ইচ্ছা বা প্রচেষ্টা বৈদেশিক শাসনকর্তাদের ছিল না। অ্যাডাম সাহেব বলেছিলেন- প্রকৃত জাতীয় শিক্ষার কোনো আয়োজন সার্থক করতে হলে, তাকে জাতীয় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে। মেকলে, দেশীয় শিক্ষার মান উন্নয়নকে সম্পূর্ণ অসম্ভব ও অবাস্তব বলে নাকচ করে দেন। তিনি পাশ্চাত্য ভাষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিকে সমর্থন করেছিলেন। প্রথম দিকে অনেক চিন্তাবিদ দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানকে গ্রহণ করার জন্য আমাদের দেশেও দাবি উঠেছিল। রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ব্রিটিশ কোম্পানি চেয়েছিলেন জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশ্চাত্য ভাবধারার একটি সম্প্রদায় গড়ে উঠুক। তারা বুঝেছিলেন, দেশের শাসনব্যবস্থাকে সচল রাখতে হলে, দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। আর তা নিজেদের দেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব নয়। তাই এই প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী সৃষ্টির জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে, যাতে কোম্পানির ইংরেজি জানা শিক্ষিত কর্মচারীর অভাব পূরণ হয়, আর তারা হবে কোম্পানির সমর্থক, এই ছিল তাদের মনোভাব। মেকলের চুঁইয়ে পড়া নীতির ফলে সমাজের উচ্চ তলার কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তি শিক্ষার সুযোগ পেত, ফলে জনসাধারণ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। উডের ডেসপ্যাচেও বলা হয়েছে, শিক্ষার মধ্য দিয়ে যোগ্য, নৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন, বিশ্বাসী কর্মচারী সৃষ্টিই হবে সরকারি শিক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্য। বণিক কোম্পানি তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা ভুলতে পারেনি। বলা হয়েছে, ইংল্যান্ডের কারখানায় কাঁচামালের যোগান দেওয়া ও ব্রিটেনে উৎপন্ন পণ্যের জন্য বাজার সৃষ্টি করাই হবে সরকারি শিক্ষানীতির আর একটি উদ্দেশ্য।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন হল, তা প্রকৃতপক্ষে পুঁথিগত শিক্ষা। বৃত্তিমূলক বা ব্যাবহারিক শিক্ষার কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিন্তু সেই সুযোগ মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি পেত। আইন, চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি কয়েকটি বৃত্তিশিক্ষার সুযোগ ছিল মুষ্টিমেয় শ্রেণির জন্য। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে শিক্ষা শেষ করে তারা প্রথমে সরকারি চাকরির চেষ্টা করত, সেই সময় সরকারি চাকরির অভাব ছিল না। যখন ইউরোপে বিজ্ঞানচর্চার ফলে নিত্যনতুন আবিষ্কার ও শিল্পজগতের বিরাট বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তখন ভারতীয়রা ইংরেজের গোলামে পরিণত হয়েছিল।

দেশের আপামর জনসাধারণ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। শিক্ষাব্যবস্থার এই বৈষম্য সমাজের বেশ কিছু উদারচেতনাসম্পন্ন মানুষের মনে আলোড়ন তুলেছিল। সামাজিক বঞ্চনা ও অর্থনৈতিক অসাম্য দেশের সাধারণ মানুষকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছিল। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতে জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটে। জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। গণশিক্ষার ব্যবস্থা কারিগরি ও বৃত্তিশিক্ষার ব্যবস্থা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও শিক্ষার প্রসার প্রভৃতির জন্য দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় দাবি তোলেন। 1885 সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেস প্রথম পর্যায়ে জনগণের মুখপাত্র হিসেবে সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করে কিছু কিছু সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালান। কিন্তু তা বিশেষ কার্যকরী হয়নি।

জাতীয় কংগ্রেসের অপেক্ষাকৃত নবীন সদস্যরা নেতৃত্বের উপর চাপ দিতে থাকেন এবং আবেদন নিবেদন নীতি পরিত্যাগ করে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের ডাক দেন। ফলে প্রবীন নেতাগণ চাপের মুখে পড়ে রণকৌশল পরিবর্তন করেন। শুরু হয় জাতীয় আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করে, দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা। এই আন্দোলন বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে সংগঠিত হয়েছিল। প্রত্যেক পর্যায়ে নিজস্ব কতকগুলি লক্ষ্য ছিল। কতকগুলি তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে তীব্র আকার ধারণ করে। জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন গড়ে ওঠে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment