জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের ঘটনাবলির বিবরণ দাও

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক কাল জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন 1905 সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে উপলক্ষ করে ব্যাপক আকার ধারণ করে। কিন্তু এর পূর্ব থেকেই এর প্রস্তুতি পর্ব চলছিল। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই 1901 সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য আশ্রম নামে আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রাচীন ভারতের তপোবনের শিক্ষাদর্শে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী গুরুকুল শিক্ষাব্যবস্থার কথা প্রচার করেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ হরিদ্বারে কাংড়ী গুরুকুলের প্রতিষ্ঠা করেন 1903 খ্রিস্টাব্দে। বৃন্দাবন গুরুকুল (1902 খ্রিস্টাব্দে) প্রথমে সেকেন্দ্রাবাদে প্রতিষ্ঠিত হয়, পরে 1911 সালে এটি বৃন্দাবনে স্থানান্তরিত হয়। ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নেতৃবৃন্দ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সমালোচনা করতে শুরু করেন। 1903 সালে আহমেদাবাদ কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষানীতির তীব্র সমালোচনা করেন।
ইতিপূর্বে 1901 সালের কার্জন সিমলা সম্মেলনের আহ্বান করলেন, 1902 সালে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন নিয়োগ এবং 1904 সালে কার্জন যখন তাঁর শিক্ষানীতি প্রকাশ করলেন, তখন দেশের নেতাদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হল। এই নীতিতে সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতি পরিষ্কার হয়ে গেল। কংগ্রেস নেতারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন ফলে বেসরকারি আইন কলেজ ও দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজগুলি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। তত
(1) ডল সোসাইটি এ সতীশচন্দ্র: শিক্ষাব্রতী সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় 1902 সালে ‘ডন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই চতুষ্পাঠীর মুখপত্র ছিল ডন পত্রিকা। ‘ডন পত্রিকা’ পরে ডন-সোসাইটির মুখপত্র হয়। এই সোসাইটির উদ্দেশ্য হল- যুব সম্প্রদায়কে শিক্ষাদান করা, শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠন করা, নৈতিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা, স্বার্থত্যাগের মহান আদর্শ গ্রহণ করা, কারিগরি বিষয়ে শিক্ষাদান করা, সর্বোপরি স্বদেশ প্রেম জাগ্রত করা।
(2) জাতীয় শিক্ষা পরিষদ: 1905 সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ছাত্রদের দমন করার জন্য সরকার নানান সার্কুলার বের করেন, তখন কলকাতার যুব সমাজ কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয়ের সভাপতিত্বে Anti circular society স্থাপন করে। এই সোসাইটির সম্পাদক হন শচীন্দ্র প্রসাদ বসু। 1905 সালের 7 নভেম্বর এক বিরাট জনসভার সুবোধচন্দ্র বসুমল্লিক জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একলক্ষ টাকা দিতে স্বীকৃত হন।
1906 সালে 12 মার্চ 92 জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় National council of education বা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাসবিহারী ঘোষ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ মনীষীগণ জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা রচনা করেন। এরপর ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল’ স্থাপনের ঘোষণা করা হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ শিক্ষাদানের ব্যাপারে অভিনব পদ্ধতি প্রবর্তন করে। এখানে সংস্কৃত, পালি, মারাঠি ও হিন্দি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় কারিগরি বিভাগে।
(3) কারিগরি শিক্ষা-উন্নয়ন সমিতি : 1906 সালে তারকনাথ পালিত “কারিগরি শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেন। রাসবিহারী ঘোষ সমিতির সভাপতি হন। সমিতি এই বছরই প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট। আর্থিক কারণে 1910 সালে এই সমিতি জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে মিশে যায়।
(4) বাংলার বাইরে জাতীয় শিক্ষা : আন্দোলন কলিকাতার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জেলায় জাতীয় মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলার 10টি শহরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই সময় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ অনুমোদিত 40টি বিদ্যালয় ছিল। 1909 সালে অন্ধ্রে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, গঠিত হয়। কারিগরি ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার জন্য যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়। 1956 সালে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পায়।
(5) জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন ও প্রাথমিক শিক্ষা : আন্দোলনের ফলে সর্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করার উদ্দেশ্যে গোখলে 1910 এবং 1911 সালে পরপর দুটি বেসরকারি বিল রাজকীয় পরিষদে উপস্থাপন করেন।
(6) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রসারে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়: কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (1904 সাল) এবং শিক্ষানীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে সারা দেশ যখন নিন্দায় মুখর, তখন কার্জন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে আহ্বান করেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কুশলতার বিদেশি শাসকদের দূরভিসন্ধিকে ব্যর্থ করে দিয়ে কার্জন প্রবর্তিত আইনকে দেশের কল্যাণের কাজে নিয়োগ করেন। জাতীয় শিক্ষার সম্প্রসারণে তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথম পর্যায়ের জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাই রাজনৈতিক আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা আন্দোলনও কিছুটা স্থিমিত হয়। সাধারণ মানুষের সমর্থন কমে যাওয়ায় আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে কিন্তু এই আন্দোলন জনজীবনে জাতীয় শিক্ষা চেতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। যার পরিণতি হল অসহযোগ আন্দোলন।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর