উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের শিক্ষায় যে দ্বন্দ্ব বা বিতর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই বিষয়ে মেকলে কী ভূমিকা নিয়েছিলেন

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের শিক্ষায় যে দ্বন্দ্ব বা বিতর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই বিষয়ে মেকলে কী ভূমিকা নিয়েছিলেন

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের শিক্ষায় যে দ্বন্দ্ব বা বিতর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই বিষয়ে মেকলে কী ভূমিকা নিয়েছিলেন
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের শিক্ষায় যে দ্বন্দ্ব বা বিতর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই বিষয়ে মেকলে কী ভূমিকা নিয়েছিলেন

সনদ আইনের 43 নং ধারায় উল্লিখিত সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উৎসাহ সাধনের জন্য যে অর্থ ব্যয় করার সুপারিশ করা হয়, সেই অর্থ ভারতীয় সাহিত্য অর্থাৎ প্রাচ্য শিক্ষা না পাশ্চাত্য শিক্ষার উন্নতিকরণে ব্যয় করা হবে, তা নিয়ে গড়ে ওঠে দুই মতবাদ বা মতবাদী দল। 1831 খ্রিস্টাব্দে এই দুই মতবাদে বিশ্বাসী কমিটির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তার ফলে শিক্ষা সম্পর্কিত কাজকর্মে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এর ফলস্বরূপ 1835 খ্রিস্টাব্দে 2 ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলের আইন সদস্য এবং শিক্ষা কমিটির সভাপতি লর্ড মেকলে তাঁর সুবিখ্যাত দলিল (Minute) প্রকাশ করে শিক্ষানীতি নির্ধারণের পথকে সুগম করে তোলেন। সনদ আইনের 43 নং ধারার ব্যাখ্যা করে মেকলে বলেন-

(1) সাহিত্য বিষয়ক: ‘সাহিত্য’ বলতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়প্রকার সাহিত্যকেই বোঝানো হয়েছে এবং ‘শিক্ষিত ভারতীয়’ বলতে কেবলমাত্র প্রাচ্যের শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকেই বোঝায় না বরং যাঁরা লকের দর্শনে, মিলটনের কবিতায় এবং নিউটনের পদার্থবিদ্যায় পারদর্শী, তাদেরকেও বোঝায়।

(2) বিজ্ঞানচর্চা: বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, বড়োলাট প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য যে বিজ্ঞানকে ভালো মনে করবেন, তারই জন্য অর্থ ব্যয় হবে।

(3) শিক্ষার উদ্দেশ্য: শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে তিনি বলেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এবং পাঠক্রমে থাকবে পাশ্চাত্য দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়।

(4) শিক্ষার মাধ্যম: শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, দেশীয় ভাষাসমূহ অত্যন্ত নিম্নমানের ও ঐশ্বর্যহীন। এই ভাষার শব্দ পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের গ্রন্থ-অনুবাদ বা ভাষাপ্রকাশে অনুপযুক্ত। সংস্কৃত, আরবি ভাষা ইউরোপীয় ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর। তিনি প্রাচ্য সাহিত্য সম্পর্কে বলেন- “A single shelf of a good European Library was worth the whole native literature of India and Arabic.” ইউরোপীয় কোনো ভালো পাঠাগারের কোনো একটিমাত্র তাকই ভারতীয় নেটিভদের সমস্ত সাহিত্য ও আরবি সাহিত্য থেকে অধিকতর সম্পদশালী। তিনি আরও বলেন, ইংরেজি ভাষা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। তা সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অফুরন্ত খনি। ইংরেজি ভাষা চর্চার ফলে এদেশের মাতৃভাষারও উন্নতি ঘটবে। ভবিষ্যতে সেই উন্নত মাতৃভাষাই হবে শিক্ষার মাধ্যম।

(5) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: মেকলে বলেছেন, প্রাচ্য শিক্ষাদানের প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করে দিতে হবে। ইংরেজি শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করতে হবে।

(6) চুঁইয়ে পড়া নীতি (Downward filtration theory): সর্বসাধারণের শিক্ষার দায়িত্বের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, সরকার কেবলমাত্র অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে শিক্ষিত করে তুলবেন এবং তাদের কাছ থেকে জনসাধারণের কাছে শিক্ষা ক্রমশ চুঁইয়ে পড়বে। একেই বলে চুঁইয়ে পড়া নীতি বা Downward filtration theory

(7) খাঁটি ইংরেজ তৈরি: পাশ্চাত্য শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বলেন, “সরকারি শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হবে একটি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করা, যারা রক্ত ও বর্ণের দিক দিয়ে ভারতীয় হলেও বুচি, মতাদর্শ ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক দিয়ে হবেন খাঁটি ইংরেজ।” পরিশেষে বলা যায়, মেকলের প্রতিবেদনের ঘোষণা ও পরবর্তীকালে লর্ড বেন্টিষ্কের শিক্ষানীতি দীর্ঘদিন থেকে হয়ে আসা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায় এবং ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সরকারি নীতি চালু হয়।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment