ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক বিষয়গুলি আলোচনা করো

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক বিষয়গুলি আলোচনা করো

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক বিষয়গুলি আলোচনা করো
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক বিষয়গুলি আলোচনা করো

সমাজসংস্কার

বাংলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় সমাজসংস্কারক হলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি সামাজিক কুসংস্কার ও বিভিন্ন কুপ্রথার বিরুদ্ধে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে নারীসমাজের সার্বিক উন্নয়নে ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর সমাজসংস্কারমূলক কাজগুলি হল-

(1) বিধবাবিবাহ সমর্থন : সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগরের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বিধবাবিবাহ প্রচলন। সেসময় সমাজে অতি অল্পবয়সি মেয়েদের সঙ্গে বৃদ্ধদের বিয়ে দেওয়া হত। এর ফলে অনেকে অল্পবয়সে বিধবা হত। বিদ্যাসাগর পুরাণ, পরাশর সংহিতা ও অন্যান্য শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের কথা প্রচার করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের এই কাজের জন্যই সরকার সমস্ত বিরোধী দাবি অগ্রাহ্য করে 1856 সালের 26 জুলাই বিধবাবিবাহকে আইনসম্মত বলে ঘোষণা করেন। 

বিধবাবিবাহ আন্দোলন ও বিরুদ্ধ আন্দোলন

বিধবাবিবাহের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার জন্য বিদ্যাসাগর গ্রন্থ রচনা করেন এবং পত্রপত্রিকার মাধ্যমে তা প্রচার করেন। অপরপক্ষে রাধাকান্ত দেব ছিলেন বিধবাবিবাহের ঘোরতর বিরোধী। বিধবাবিবাহের পক্ষে আইন পাস করার জন্য বিদ্যাসাগর 1855 সালের 4 অক্টোবর এক হাজার জন ব্যক্তির স্বাক্ষর-সংবলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান। এই আবেদনপত্রের বিরুদ্ধে রাধাকান্ত দেব ছত্রিশ হাজার সাতশো তেষট্টি জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে একটি পালটা আবেদনপত্র পাঠান।

(1) বিধবাবিবাহের ঘটনা: বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় যে বিধবাবিবাহগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-

  • শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও কালিমতীর বিবাহ: 1856 সালের 7 ডিসেম্বর। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও বিধবা কালিমতীর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
  • নারায়ণ ও ভবসুন্দরীর বিবাহ: বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণের সঙ্গে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার বিবাহ দেন। বিদ্যাসাগর নিজ উদ্যোগে এবং অর্থব্যয়ে অনেক বিধবা নারীর বিবাহ দিয়েছিলেন।

(2) বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন: বিদ্যাসাগর সমাজের অপর একটি কুপ্রথা বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। তিনি বহুবিবাহের বিরুদ্ধে গ্রন্থ রচনা করে ও শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে নানা প্রচার করেন। তিনি 1855 সালের ডিসেম্বরে বহুবিবাহ রদ করার জন্য সরকারের কাছে পঁচিশ হাজার জন ব্যক্তির স্বাক্ষর-সংবলিত একটি আবেদনপত্র পেশ করেন। অপরপক্ষে রাধাকান্ত দেব এক হাজার দুশো আটত্রিশ জনের স্বাক্ষর- সংবলিত একটি পালটা আবেদনপত্র পেশ করেন। এবার ব্রিটিশ সরকার আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহবিরোধী আন্দোলন বিশেষ সাফল্য লাভ করেনি, তবে বহুবিবাহের প্রবণতা হ্রাস পেয়েছিল।

(3) বাল্যবিবাহের বিরোধিতা: বাল্যবিবাহ রোধে বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর মতামতের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করেন। 1850 সালে প্রতীক্ষিত সর্বশুভকরী সভার মুখপত্র সর্বশুভকরী পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই তিনি “বাল্যবিবাহের দোষ” শীর্ষক এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। হিন্দু বাল্যবিধবাদের দুঃসহ জীবন তাঁকে প্রচণ্ড ব্যথিত করত। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ রচনা করে প্রতিবাদে অবতীর্ণ হন। তাঁর আন্দোলনের ফলে মেয়েদের বিয়ের বয়স 10 বছর ধার্য করা হয়েছিল। বাল্যবিবাহের পক্ষে রক্ষণশীল বাঙালিরা ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন করেছিল। তৎকালীন সমাজের কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধেও বিদ্যাসাগর সোচ্চার হয়েছিলেন। 

অন্যান্য সামাজিক সংস্কার

বিধবাবিবাহের পক্ষে এবং বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছাড়াও বিদ্যাসাগর অন্যান্য সামাজিক কুপ্রথা, যেমন- কুলীন প্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।

(1) প্রকৃত সচেতন মানুষ তৈরির জন্য উপযুক্ত শিক্ষার স্রষ্টা : বিদ্যাসাগরের সময় জনশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা অবহেলিত হত এবং পাশাপাশি অব্রাহ্মণদের কিছু নামীদামী বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার ছিল না, অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বের ফলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যহত হত এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকত না। কারণ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছিল সম্প্রদায়ভিত্তিক, ফলে শিক্ষা একেবারে একপেশে, সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ ছিল। তাই বিদ্যাসাগর তার দূরদর্শীতার দ্বারা বিরাট কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত মানুষ তৈরির উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করার নিরলস চেষ্টা করেন।

(2) সুরাপান বন্ধের প্রচেষ্টা: বিদ্যাসাগর ইয়ং বেঙ্গলদের প্রগতিশীল চিন্তা ও কুসংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করলেও তাদের সুরাপানকে বিদ্যাসাগর সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। 1864 সালে প্যারীচরণ সরকার সুরাপান বন্ধ করতে একটি সমিতি গঠন করলে বিদ্যাসাগর সেই সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বিদ্যাসাগর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সংস্কৃতির মধ্যে যা কিছু সুস্থ ও সুন্দর সেগুলির মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন।

(3) হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড: বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাদের দূরাবস্থার কথা ভেবে তাদের জন্য হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড গঠন করেন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment