আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কীভাবে জাতীয় শিক্ষায় সহায়তা করেছিলেন

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কীভাবে জাতীয় শিক্ষায় সহায়তা করেছিলেন

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কীভাবে জাতীয় শিক্ষায় সহায়তা করেছিলেন
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কীভাবে জাতীয় শিক্ষায় সহায়তা করেছিলেন

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা

ভারতের জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (1904 সাল) এবং শিক্ষানীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে সারা দেশ যখন নিন্দায় মুখর, তখন কার্জন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে আহ্বান জানান স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। 1906 সালে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ গ্রহণ করেন। আশুতোষ তাঁর ব্যক্তিগত কুশলতা ও অবিচল দৃঢ়তায়, কার্জনের প্রবর্তিত আইনকে দেশের কল্যাণে নিয়োজিত করেন। দেশব্যাপী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দেওয়া তাঁর জীবনের ব্রত ছিল। জাতীয় শিক্ষার সম্প্রসারণে তাঁর অবদানগুলি হল-

(1) বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য সম্বন্ধে আশুতোষের মতামত: বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমার মতে বিশ্ববিদ্যালয় হবে এক জ্ঞানের ভাণ্ডার, শিক্ষামানের এক প্রভাবশালী নিয়ামক, বিরাট যজ্ঞশালা, চিন্তা ও কাজের মানুষ তৈরির এক বিরাট পরীক্ষাগার। বিশ্ববিদ্যালয় হলে জ্ঞান সংরক্ষণ, জ্ঞান প্রয়োগ এবং সর্বোপরি জ্ঞান স্রষ্টা তৈরির যন্ত্র।”

(2) কর্মসূচি:

  1. উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করে স্যার আশুতোষ দুটি কাজে হাত দিলেন (a) একটি হল দ্বারভাঙা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার স্থাপন করা। (b) অপরটি হল 1908 সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপাখানা স্থাপন করা।
  2. মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণের জন্য তিনি উদারভাবে স্কুল ও কলেজের অনুমোদনের দ্বার খুলে দেন।
  3. প্রবেশিকা পরীক্ষায় উদারনীতি গ্রহণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রসারের চেষ্টায় নিযুক্ত হন।
  4. 1904 সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে শিক্ষণধর্মী হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়। আইনের এই সুযোগ নিয়ে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের পঠন-পাঠন শুরু করেন।
  5. উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন বিষয় সংযোজন করেন। 1913 সালের মধ্যে 11টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়।
  6. তাঁর চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো সময়ের জন্য প্রফেসর, রীডার, লেকচারার ইত্যাদি পদ সৃষ্টি হয়। তাঁর প্রচেষ্টায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
  7. বিশ্ববিদ্যালয় আইনে (1904 সাল) বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অধ্যাপক ও অন্যান্য শিক্ষাকর্মী নিয়োগের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়, তার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের জ্ঞানী-গুণিদের একত্রিত করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার দায়িত্ব দেন।
  8. তিনি বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেষ্ট ছিলেন। তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষের অকৃপণ দানে তিনি বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন করেন।
  9. বাংলা ভাষা-সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা অধ্যয়নের ব্যবস্থা তিনি করেন।
  10. আইন শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থার জন্য 1909 সালে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইন কলেজ স্থাপন করেন।
  11. আশুতোষের উৎসাহে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পি সি মিত্র, সি ভি রমন, প্রতিভাবান অধ্যাপকগণ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। অর্থনীতিতে মিন্টো অধ্যাপকপদ, উচ্চতর অঙ্কশাস্ত্রের জন্য হার্ডিঞ্জ অধ্যাপকপদ, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের জন্য অধ্যাপকপদ সৃষ্টি করা হয়।
  12. বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য তিনি যেভাবে কৃর্তপক্ষের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন, তা বর্তমান যুগে উদাহরণস্বরূপ।

(3) জাতীয় ঐক্য ও সংহতির চেষ্টা: তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার সাহায্যে সমগ্র জাতির মানসিক ঐক্য, সংহতি ও দেশপ্রেম জাগ্রত করা যায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভারতীয় ভাষা পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর চেষ্টায় বাংলা, অসমিয়া, মৈথিলি, ওড়িয়া, হিন্দি, উর্দু, গুজরাটি, দ্রাবিড়, তামিল, মালয়ালম, কানাড়ি ও সিংহলি ভাষাসমূহের চর্চা ও পঠন-পাঠন শুরু করেন।

(4) মাতৃভাষা: তিনি দেশের যুবকদের বলেছিলেন, ‘মাতৃভাষার মধ্য দিয়েই দেশের জনসাধারণের হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে।’ 1921 সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার ব্যবস্থা করেছিলেন।

(5) জাতীয় সাহিত্য : কোনো একটি বিশেষ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করলে জাতীয় সংহতি সৃষ্টি হবে, তা তিনি মনে করেননি, কারণ এতে বিভিন্ন প্রদেশসমূহ তাদের নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলবে। তাই তিনি এক ভাষা চান নি, তিনি সংহতির জন্য চেয়েছিলেন জাতীয় সাহিত্য।

(6) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার দাবি: তিনি নিজেকে দিয়েই প্রমাণ করেছিলেন, জাতীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধির স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহার করা যাবে। তৎকালীন সরকারের সঙ্গে বিরোধ হলে, তীব্র প্রতিবাদ জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপে বাংলার বাঘ আশুতোষ গর্জে ওঠেন। 1922 সালে স্পষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা দাবি করেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- “Freedom first, freedom second, freedom always” তাঁর প্রবল প্রতিবাদে সরকার বিরত থাকতে বাধ্য হন। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েও তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেই সেই আন্দোলনকে অনেকটাই বাস্তবায়িত করতে পেরেছিলেন। আজকের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁরই সৃষ্টি।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment