বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান লেখো
অথবা,
ত্রিপিটক কী? বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

ত্রিপিটক
বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ হল ত্রিপিটক। এই ত্রিপিটকের ওটি অংশ। যথা- (1) সূত্রপিটক: এর মধ্যে আছে বুদ্ধদেবের উপদেশ ও বাণী,(2) বিনয়পিটক: এর মধ্যে আছে বৌদ্ধ শ্রমণ ও ভিক্ষুদের পালনীয় কর্তব্য এবং(3) অভিধম্মপিটক: অভিধম্মপিটকে আছে বৌদ্ধতত্ত্ব ও দর্শন সম্পর্কে আলোচনা।
বৌদ্ধ শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার সংকীর্ণতা ও যাগযজ্ঞ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিবাদ স্বরূপ বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে বৌদ্ধযুগ পরম গৌরবময় যুগ। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বেশি সর্বজনীন হওয়ায় শুধু ভারতবর্ষ নয়, ভারতের বাইরে বহু দেশের মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। এই শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে আলোচনা করা হল।
(1) শিক্ষার লক্ষ্য:
- পরিনির্বাণ লাভ: পরিনির্বাণ ছিল বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। দুঃখ জর্জরিত জাগতিক সর্বপ্রকার বন্ধনের অবসান ঘটিয়ে চিরতরের জন্য মুক্তি লাভই হল পরিনির্বাণ বা নির্বাণ লাভ। মানুষের অজ্ঞতাই হল তার দুঃখের কারণ। অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলনের মাধ্যমে অজ্ঞতা দূর করলেই মানুষ পরিনির্বাণ লাভ করবে।
- চারিত্রিক দৃঢ়তা সৃষ্টি: অসত্য, অন্যায়, অসৎ আচরণ, চৌর্যবৃত্তি এবং জীবের প্রতি হিংসা পরিহার প্রভৃতি যে পঞ্চশীল নীতির কথা বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে সে বিষয়ে চারিত্রিক দৃঢ়তা সৃষ্টি করাই ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য।
(2) পাঠক্রম: বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রমে ধর্মীয় বিষয়সহ ত্রিপিটককে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বুদ্ধদেব বেদবিরোধী ছিলেন না। তাই বেদ, পুরাণ, গণিত ইত্যাদি বিষয়ও পাঠক্রমে স্থান দেওয়া হয়েছিল।
(3) শিক্ষারম্ভ বা প্রব্রজ্যা : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা যেমন উপনয়ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হত ঠিক তেমনই বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হত প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। যে-কোনো বর্ণের লোকই প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারত। তবে রাজকর্মচারী, ক্রীতদাস, চোর-ডাকাত, হত্যাকারী, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠ, চর্ম ও মৃগী রোগীদের সংঘে প্রবেশের অধিকার ছিল না। প্রব্রজ্যা গ্রহণের বয়স আট বছরের কম হলে চলত না ও পিতা-মাতার অনুমতির প্রয়োজন ছিল। প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর শিক্ষার্থী গুরুকে প্রণাম করে ত্রিস্মরণ মন্ত্র উচ্চারণ করত- “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি”। তখন শিক্ষার্থীকে বলা হত শ্রমণ।
(4) শিক্ষাকাল: শ্রমণদের জন্য শিক্ষার কাল ছিল বারো বছর।
(5) বাৎসরিক শিক্ষার সময় : প্রথাগতভাবে বর্ষাকালেই শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল।
(6) শিক্ষালয় / বিহার : বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষালয় বলতে বৌদ্ধ বিহারগুলিকেই বোঝায়। এগুলি ছিল আবাসিক। বৌদ্ধভিক্ষুরা বিহারে অবস্থান করতেন। তাঁরাই শ্রমণদের পাঠগ্রহণে সহায়তা করতেন। এখানে শিক্ষার্থীদের সংঘের নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলতে হত। বৌদ্ধ শিক্ষার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শিক্ষাকেন্দ্র হল নালন্দা, বিক্রমশীলা, তক্ষশিলা প্রভৃতি।
(7) শিক্ষণ পদ্ধতি: শিক্ষণ পদ্ধতি ছিল মূলত মৌখিক। তবে লিপির প্রচলন ছিল। মুখস্থ ও আবৃত্তির উপর জোর দেওয়া হত। এ ছাড়া আলোচনা, উপদেশমূলক গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হত। বিতর্ক ও আলোচনার উপর গুরুত্ব দেওয়া হত।
(৪) শিক্ষার মাধ্যম: শিক্ষার মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা ও আঞ্চলিক ভাষা। পরবর্তীকালে পালি ও সংস্কৃত ভাষাও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব লাভ করে।
(9) শৃঙ্খলা: মঠবাসী শিক্ষার্থীদের কঠোরভাবে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হত। নির্দিষ্ট অনুশাসন অনুসরণ করে শিষ্যকে বাধ্যতামূলকভাবে ভিক্ষায় যেতে হত। কোনো শিষ্য মঠের নিয়ম ভঙ্গ করলে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। এমনকি গুরু শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে বা কর্তব্যে অবহেলা করলে তাঁকেও নিয়মমাফিক শাস্তি পেতে হত। প্রতিমোক্ষ নামক শাস্ত্র থেকে জানা যায় সংঘজীবন বেশ কঠোর ছিল।
(10) ভ্রমণ: ‘প্রব্রজ্যা’ গ্রহণের পর শিক্ষার্থীকে শ্রমণ বলা হত। বিহার জীবনে শ্রমণকে ব্রহ্মচর্য পালন এবং কঠোর অনুশাসন মেনে চলতে হত।
(11) সর্বজনীনতা: বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সর্বজনীন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব ধরনের শিক্ষার্থীরা শিক্ষালাভের সুযোগ পেত। তবে অপরাধী বা রোগগ্রস্ত ব্যক্তিরা সংঘে প্রবেশ করতে পারত না।
(12) গুরু-শিষ্য সম্পর্ক: বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর এবং পিতা-পুত্রের ন্যায়। উভয়ই পরস্পরের প্রতি কর্তব্য পালন করত। গুরু সংঘজীবনের আদর্শচ্যুত হলে ছাত্ররা তার প্রতিবাদ করতে পারত। আর শিষ্যরা অপরাধ করলে গুরু তাঁদের শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতেন।
(13) গণশিক্ষা: বৌদ্ধ শিক্ষা গণতান্ত্রিক হওয়ার ফলে সংঘগুলির চেষ্টায় এখানে গণশিক্ষার প্রসার হয়েছিল।
(14) মূল্যায়ন ব্যবস্থা: সংঘের মূল্যায়ন কৌশল ছিল মৌখিক এবং প্রশ্নোত্তর আলোচনা। ১২ বছরকাল গুরুর অধীনে শিক্ষালাভের পর মূল্যায়নের ভিত্তিতে শ্রমণকে উপসম্পদা উপাধি দেওয়া হত।
(15) উপসম্পদা: সংঘে শ্রমণের ১২ বছর আবাসিক শিক্ষা লাভের পর ‘উপসম্পদা’ নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটত। ২০ বছরের আগে কাউকে উপসম্পদা দেওয়া হত না।
(16) নিয়মানুবর্তিতা : বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার মতো বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থাতেও। শিক্ষা এবং নিয়মানুবর্তিতা একইরকম ছিল। প্রত্যেক শ্রমণকে 10 টি শীল। পালন করতে হত। মিথ্যা কথা বলা, মদ্যপান, দানবহির্ভূত দ্রব্য গ্রহণ করা,। অপবিত্র আচরণ, অসময়ে ভোজন করা, নৃত্য এবং সংগীতে অংশগ্রহণ করা, মালা, পাদুকা, সুগন্ধি, অলংকার ও গন্ধদ্রব্য ব্যবহার, উচ্চাসনে উপবেশন ও স্বর্ণরৌপ্য গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।
(17) বৃত্তিশিক্ষা: জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য বৌদ্ধ শিক্ষায়। প্রথম থেকে কতকগুলি বৃত্তিশিক্ষাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। সেগুলি হল- সুতা কাটা, কাপড় বোনা, দর্জির কাজ ইত্যাদি।
(18) নারীশিক্ষা: প্রথমে বুদ্ধদেব নারীদের বৌদ্ধ সংঘে প্রবেশের বিরুদ্ধে ছিলেন কিন্তু পরে মহা প্রজাপতি গৌতমী ও তাঁর প্রিয় শিষ্য আনন্দের অনুরোধে তিনি মেয়েদের সংঘে স্থান দিতে রাজি হন। এদের বলা হত। ভিক্ষুনি।
(19) বিতর্ক সভা ও আলোচনা সভা: বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় বিতর্ক সভা ও। আলোচনা সভার একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল। বিতর্ক ব্যবস্থা ছিল জ্ঞান। পরিমাপের মানদণ্ড। বিতর্কে বিজয়ীকে পুরস্কৃত করে তার নাম বিহারের সিংহ। দ্বারে লেখা থাকত। উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল ফলে শিক্ষা সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃত প্রভাব রেখে গেছে। বর্তমানে তার প্রভাব আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা আন্তর্জাতিক স্তরেও বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিল।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর