বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার যে-কোনো দুটি অনুষ্ঠান ও তার গুরুত্ব লেখো

বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার দুটি প্রধান অনুষ্ঠান হল- উপনয়ন এবং সমাবর্তন।
উপনয়ন
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা পাঁচ বছর বয়সে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হত। এই অনুষ্ঠানটি ‘বিদ্যারম্ভ’, ‘চৌল কর্ম’, ‘অক্ষর স্বীকরণ’ ইত্যাদি নামে পরিচিত। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিশু গৃহপরিবেশে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারত। পরিবারের মধ্যে থেকে শিশু বেদপাঠ গ্রহণ করত। কিন্তু পরবর্তীকালে বৈদিক শিক্ষা জটিল হয়ে পড়ায় গুরুর প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়ল। গুরুগৃহে পাঠ শুরু করার জন্য প্রয়োজন হল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যার নাম উপনয়ন।
(1) গুরুত্ব: উপনয়ন শব্দের অর্থ শিক্ষার্থীকে গুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া, উপনয়নের মাধ্যমে ব্রহ্মচর্য আশ্রমে শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করত। উপনয়নের পর শিক্ষার্থীরা দ্বিজ নামে পরিচিত হত। ‘দ্বিজ’ কথার অর্থ দু-বার জন্ম যার। উপনয়নের দ্বারা শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় জন্ম ধরা হত। ৪ বছরে ব্রাহ্মণ, 11 বছরে ক্ষত্রিয় ও 12 বছরে বৈশ্যদের উপনয়ন হত।
(1) বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় উপনয়ন ছিল একটি আবশ্যিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী গুরুর নিকট বিদ্যা গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করত।
(2) উপনয়নের মধ্য দিয়ে শিশু নবজন্ম লাভ করত।
(3) উপনয়নের পর শিক্ষার্থী গুরুগৃহে থেকে শিক্ষা লাভ করত। এখানে সে পূর্ণ ব্যক্তিসত্তা বিকাশের সুযোগ পেত।
(4) উপনয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থী বেদ, ব্রত, নিয়মকানুন, আত্মসংযম, চরিত্রগঠন ইত্যাদি শিক্ষার সুযোগ লাভ করত।
(5) এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিষ্য প্রথম গুরুর নিকটে আসতে পারত। গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক পিতা-পুত্রের মতো নিবিড় হত।
(6) উপনয়নকালে শিক্ষার্থীকে মস্তক মুণ্ডন, কৌপীন ও মেখলা ধারণ করতে হত। গুরু শিক্ষার্থীর নাম, পিতৃপরিচয়, গোত্র ইত্যাদি জেনে উপযুক্ত মনে হলে তবেই তাকে শিক্ষার্থীরূপে গ্রহণ করতেন।
সমাবর্তন
- বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর শিক্ষা শেষ হত। এই অনুষ্ঠানটি হল সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
(2) গুরুত্ব: বেদ বিদ্যাপাঠ সমাপন করে সমাবর্তনের যোগ্য হওয়া যেত। শিক্ষার্থী তখন স্নাতক হিসেবে পরিগণিত হত। স্নাতক তিন ধরনের:
- বিদ্যাস্নাতক: যারা বেদপাঠ সমাপ্ত করেছে কিন্তু সমস্ত ব্রত পালন করেনি।
- ব্রতস্নাতক: যারা বেদপাঠ সমাপ্ত না করে শুধু ব্রত সমাপন করেছে তারা ব্রতস্নাতক।
- বিদ্যাব্রত স্নাতক: যারা বেদপাঠ ও ব্রত দুটিই সমাপন করেছে তাদের বলা হত বিদ্যাব্রত স্নাতক।
- এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপ্তি ঘোষণা করা হত। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ব্রহ্মচর্য আশ্রম শেষ করে গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করতে পারত।
- সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীকে স্নান করে, নতুন বস্ত্র পরিধান করে, গলায় মালা পরে রথে বা হাতিতে চড়ে পণ্ডিতগণের কাছে উপস্থিত হতে হত। গুরু পণ্ডিতগণের কাছে শিক্ষার্থীকে স্নাতক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। সুষ্ঠু নিয়মনীতি পালনের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীর ব্রহ্মচর্যাশ্রম শেষ হত।
- সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিষ্য তার সাধ্যমতো গুরুদক্ষিণা দিয়ে গুরুর অনুমতি নিয়ে গৃহে ফিরতে পারত। শিষ্যকে কখনোই জোর করা হত না গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্য, যা অত্যন্ত ভালো মানসিকতার সাক্ষ্য বহন করে।
- গুরু শিষ্যকে অনুমতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনে চলার পাথেয় হিসেবে কতকগুলি মূল্যবান উপদেশ দিতেন, যা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উপদেশ। সেগুলি হল- সর্বদা সত্যকথা বলবে। ন্যায়সংগত আচরণ করবে। সারাজীবন পিতা-মাতা ও গুরুজনকে দেবতা জ্ঞানে সম্মান করবে। ন্যায় আচরণের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। আচার্য এবং অতিথিকে দেবতা মনে করবে। আর্ত হয়েও অপরকে পীড়িত করবে না। বিদ্যাচর্চার পথ পরিহার করবে না। অপরের প্রতি হিংসার মনোভাব পোষণ করবে না। অপরের পীড়াদায়ক এমন কোনো বাক্য কখনও উচ্চারণ করবে না।
গুরুর এই বাণী শিষ্যদের কাছে শ্রেষ্ঠ উপদেশ বলে বিবেচিত হত। এগুলি আমাদের চলার পথে দিনির্দেশ করতে সাহায্য করবে।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর