বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
(1) যতিচিহ্নের ব্যবহার: বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষাকে সহজ ও সুন্দর করে এক নতুন রূপ দেন এবং তাকে পৌঁছে দেন বাঙালির প্রতিটি ঘরে ঘরে। বাংলা গদ্যের বিকাশে তাঁর দান অসামান্য। তিনি প্রচুর পরিমাণে যতিচিহ্ন ব্যবহার করে বাক্যের অর্থকে সহজে বোধগম্য করে তোলেন। বাংলা গদ্য পাঠে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য তিনি সেমিকোলন, কমা প্রভৃতির প্রবর্তন করেন। বাংলা রচনার মধ্যে এই ছেদ ও যতিচিহ্নের ব্যবহার বাংলা সাহিত্যজগতে এক নবযুগের সূচনা করেছিল।
(2) বর্ণপরিচয়: বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি অনবদ্য গ্রন্থ। তিনি প্রথম বাংলা লেখার যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। এ ছাড়া তিনি লেখনীর মধ্যে কথ্যভাষার প্রয়োগ ঘটান এবং বিজ্ঞানসম্মত উচ্চারণের উপর গুরুত্ব দেন। তিনি ‘বর্ণপরিচয়‘ থেকে ‘ঋ’, ‘৯’-কে বাদ দেন এবং অনুস্বর (ং) ও বিসর্গ (ঃ) স্বরবর্ণের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ব্যঞ্জনবর্ণের তালিকায় যুক্ত করেন। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগটি প্রকাশিত হয় 1855 সালে। পরে আবার বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগও প্রকাশিত হয়। এই বর্ণপরিচয়ের শতবর্ষ পার হওয়ার পরেও বাংলা সাহিত্যের মহান সম্পদ হিসেবে এটি আজও পরিগণিত হয়।
(3) বাংলা পুস্তক ও বিদ্যাসাগর: তাঁর শিক্ষা চিন্তা ও প্রসারের অন্যতম হল বাংলা ভাষা শিক্ষা ও বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার জন্য পর্যায়ক্রমিক পাঠ্যপুস্তক রচনা ও শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করা। তাঁর বিখ্যাত পুস্তকগুলির মধ্যে বর্ণপরিচয় ছাড়া বোধোদয় (1851), কথামালা (1856), আখ্যানমঞ্জুরী, জীবনচরিত (1849), বেতাল পঞ্চবিংশতি (1846) প্রভৃতি ছিল অন্যতম। তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকীর্তিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস, মেঘদূত, শকুন্তলা, হর্ষচরিতম ইত্যাদি। বহুবিবাহ প্রথার বিলোপ ও বিধবাবিবাহের প্রচলনের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর কয়েকটি ব্যাঙ্গরসাত্মক পুস্তিকা রচনা করেন। এইগুলির মধ্যে কস্যচিৎ উন্নয়ক ভাইপোস্য, রত্নপরীক্ষা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
(4) অনুবাদ গ্রন্থ: বিদ্যাসাগরের অনুবাদ সাহিত্যের মধ্য দিয়েই তাঁর সাহিত্যে রসানুভূতির পরিচয় মেলে। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করে তিনি সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে বিদেশি সাহিত্যের দরজা খুলে দেন। তিনি সংস্কৃত শিক্ষাকে সহজ ও উন্নত করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি শেকসপিয়রের ‘কমেডি অফ এররস্’-এর অনুবাদ করেছিলেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নাম দিয়ে। এ ছাড়াও তিনি মার্সম্যানের ‘History of Bengal’ নামে একটি গ্রন্থের অনুবাদ করেন। এই অনূদিত গ্রন্থটির নাম দেন ‘বাংলার ইতিহাস’। হিন্দির ‘বৈতাল পচ্চিশি’ থেকে অনুবাদ করেন ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। এ ছাড়া ‘ঈশপ ফেবেল্স’ বইটির অবলম্বনে বিদ্যাসাগর ‘কথামালা’ গ্রন্থটি লেখেন। সংস্কৃত ভাষায় লেখা কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’-এর বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন তিনি এবং নাম দেন ‘শকুন্তলা’। বিদ্যাসাগর ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ ও ‘উপক্রমণিকা’ নামে দুটি সংস্কৃত ব্যাকরণ বাংলায় অনুবাদ করেন।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর