বর্তমান শিক্ষায় বৈদিক যুগের শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা লেখো

বর্তমান শিক্ষায় বৈদিক যুগের শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা লেখো

বর্তমান শিক্ষায় বৈদিক যুগের শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা লেখো
বর্তমান শিক্ষায় বৈদিক যুগের শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা লেখো

আধুনিক ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বৈদিক শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করতে হলে প্রাচীন বৈদিক শিক্ষার কতকগুলি দিককে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা প্রয়োজন। সেগুলি হল-

(1) শিক্ষার লক্ষ্য: বৈদিক যুগে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল একটি সৎ, চরিত্রবান, সত্যবাদী, শিষ্য তৈরি করা। আধুনিক ভারতীয় শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটানো। বৈদিক যুগে যেমন শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হত তেমনই আধুনিক শিক্ষাতেও এই নৈতিকতাবোধের উপর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জ

(2) শিক্ষার সময়কাল: বৈদিক যুগে একটি নির্দিষ্ট বয়সে উপনয়নের মাধ্যমে শিক্ষারম্ভ হত, আধুনিক ভারতেও প্রথাগত শিক্ষা শুরু হওয়ার একটি নির্দিষ্ট বয়স রয়েছে।

(3) অবৈতনিক শিক্ষা: বৈদিক যুগে শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। আমাদের দেশীয় আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আমাদের দেশের শিক্ষা বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তীতে দেশে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যার প্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। সুতরাং এক্ষেত্রে বৈদিক যুগের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার প্রতিফলন ঘটেছে।

(4)  শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক: বৈদিক যুগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ছিল অতি মধুর। যেখানে গুরু শিষ্যদের পুত্রের মতো স্নেহ করতেন, ঠিক একইভাবে শিষ্যরাও গুরুদের সেবা করত। সেই আদর্শকে আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন কমিশন, কমিটি ও জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধুর সম্পর্কের উপর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উভয়ক্ষেত্রেই মূল্যবোধের সংকট দেখা যাচ্ছে। বৈদিক ভাবধারায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সহজসরল সম্পর্ক শিক্ষাক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(5) নারীশিক্ষার সুযোগ: বৈদিক যুগে নারীশিক্ষার সুযোগ ছিল। যদিও বৈদিক পরবর্তী যুগে এই সুযোগ কিছুটা কমলেও বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নারী ও পুরুষদের সমানাধিকার স্বীকৃত। নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়েও এগিয়ে।

(6) শিক্ষা পরিচালনা: বৈদিক যুগে শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুদের দ্বারা শিক্ষা সংক্রান্ত সবকিছু পরিচালিত হত। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠক্রম প্রণয়ন, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষা সংক্রান্ত কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উপর দায়িত্ব রয়েছে। বর্তমান কমিশন, কমিটি, জাতীয় শিক্ষানীতিতেও এর প্রতিফলন রয়েছে।

(7) আবাসিক শিক্ষা : বৈদিক যুগে শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে শিক্ষাগ্রহণ করত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সবকিছুর দায়িত্বই ছিল গুরুর। আবাসিক শিক্ষার চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশেও আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। তবে বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং অর্থনৈতিক কারণে আবাসিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমেছে। এখনও বেশ কিছু আবাসিক বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলির কোনোটিই অবৈতনিক নয়। এই আবাসিক ধারণা বৈদিক যুগ থেকে এসেছে।

(৪) শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বজনীনতা: বৈদিক যুগে প্রথমে শিক্ষা সবার জন্যই মুক্ত ছিল। পরবর্তীতে শিক্ষাক্ষেত্রে বর্ণভেদ প্রথা চালু হয়। বৈদিক যুগের প্রথমে শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণিবিন্যাস ছিল না বর্তমানেও আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই একধরনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এই ধারণা শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয় বিশ্বের সর্বত্রই এই ধারণা স্বীকৃতি লাভ করেছে।

(9) শৃঙ্খলা: প্রাচীন ভারতের শিক্ষায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলতে হত। বর্তমানে শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে শিথিলতা এসেছে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। তবে শৃঙ্খলার কঠোরতার পরিবর্তে এমন ধরনের শৃঙ্খলাবোধ থাকা উচিত, যা শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

(10) সমাবর্তন: বৈদিক যুগের শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুগৃহ শেষ করার পর সমাবর্তন উৎসবের প্রচলন ছিল। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতেও স্নাতক, স্নাতকোত্তর স্তরের ডিগ্রির স্বীকৃতি স্বরূপ সমাবর্তন উৎসবের মাধ্যমে ডিগ্রি দানের ব্যবস্থা রয়েছে।

(11) শিক্ষাদান পদ্ধতি: বৈদিক যুগে ‘শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল মৌখিক এবং গুরুকেন্দ্রিক। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং শিক্ষাদান পদ্ধতির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, চাহিদার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

(12) শিক্ষক বিনিময়: প্রাচীন ভারতে এক শিক্ষাকেন্দ্রের গুরু অপর শিক্ষাকেন্দ্রে যেতে পারতেন এবং বিভিন্ন আলোচনায় যোগ দিতেন। বর্তমানেও শিক্ষক বিনিময় পদ্ধতি কার্যকরী।

(13)  মূল্যায়ন: বৈদিক যুগে বিভিন্ন পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্কবিদ্যা আলোচনার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হত, তবে বর্তমানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্তরের মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে।

সুতরাং বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় রুখতে একজন শিক্ষার্থীর চরিত্রগঠন, নৈতিকতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, আচার-আচরণ ইত্যাদির জন্য বৈদিক যুগের শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment