প্রযুক্তি (Technology) বলতে কী বোঝো? পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে ইউরোপে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির পরিচয় দাও
অথবা, প্রযুক্তির ধারণা দাও। নবজাগরণের যুগে প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে কীরূপ অগ্রগতি ঘটেছিল

প্রযুক্তির ধারণা
Technology হল মানুষ কর্তৃক এগিয়ে চলার জন্য উপযোগী কলাকৌশল, হাতিয়ার ইত্যাদির আবিষ্কার। যে পদ্ধতিতে দ্রুত ও স্বল্প শ্রমে কোনও গুণগতমানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়, তাকে প্রযুক্তি বলে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের দিকটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
(1) নামকরণ: প্রযুক্তি বা টেকনোলজি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ধ্রুপদি গ্রিক শব্দ টেকনে (Tekhne) থেকে, যার অর্থ কোনও কিছু উদ্ভাবন করার জ্ঞান। পরবর্তীকালে জার্মান টেকনিক (Technik) শব্দ এবং ফরাসি শব্দ টেকনিক (Technique) থেকে আধুনিক টেকনোলজি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।
(2) প্রযুক্তির বিবর্তন: আদিম মানুষের প্রথম আগুনের আবিষ্কার এবং হাতিয়ার নির্মাণের মাধ্যমে প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রাচীন কালে সূচালো গাছের ডাল, গাছের গুঁড়ি এবং পাথর দিয়ে মানুষ শিকার এবং দৈনন্দিন নানান কাজকর্ম করত। ক্রমে তারা আবিষ্কার করল চাকা, তৈরি করতে শুরু করল মৃৎপাত্র এবং ধাতুনির্মিত দ্রব্য। পাশাপাশি চাষবাস, বয়নশিল্পের পথ ধরে প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যে বিজয়রথ অগ্রসর হল, পরবর্তীতে সেই অগ্রগতির সুফলই সমৃদ্ধ করল কৃষি, সামরিক, মুদ্রণ, জাহাজ নির্মাণ এবং উৎপাদন শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে।
পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে ইউরোপে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি/নবজাগরণ পর্বে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি
পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক তথা নবজাগরণ বা তার পরবর্তী কালপর্বে ইউরোপে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছিল। এই সময়ে কৃষি, ধাতুবিদ্যা, বয়নশিল্প, সামরিক ক্ষেত্র ইত্যাদিতে যে অগ্রগতি দেখা দিয়েছিল, নিম্নে তা আলোচনা করা হল-
(1) কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তি: কৃষিক্ষেত্রে পঞ্চদশ শতক থেকে প্রযুক্তিগত উন্নতি লক্ষ করা যায়। এই সময় জমিতে কর্ষণের কাজে ঘোড়ায় টানা মই, বীজ বপন করার জন্য ভারী লোহার ফলাযুক্ত লাঙল ও কাঠের মই ব্যবহৃত হত। এ ছাড়া জমির আগাছা পরিষ্কারের জন্য নিড়ানি ও বনভূমি কেটে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করার জন্য লোহার ভারী কুঠারও তৈরি হয়। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে (১৭০১ খ্রিস্টাব্দে) জেথরো টুল (Jethro Tull) আবিষ্কার করেন ঘোড়ায় টানা শস্য বোনার যন্ত্র। অন্যদিকে উন্নতি ঘটে জলসেচেও। এ ছাড়া বেষ্টনী পদ্ধতি (Encloser System), নিবিড় কৃষির মাধ্যমে কৃষিজমির যেমন উর্বরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তেমনই বাড়ে উৎপাদনও।
(2) খনি ও ধাতুবিদ্যায় অগ্রগতি: নবজাগরণের প্রাক্কালে ইউরোপে খনি থেকে লোহা, তামা ইত্যাদি ধাতুর উত্তোলন ও আকর থেকে ধাতু নিষ্কাশন করা হত। সম্ভবত ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে আবিষ্কৃত হয় ধাতুগলন পদ্ধতি। পঞ্চদশ শতকে লোহা ঢালাই প্রযুক্তির অগ্রগতি হয়। পরবর্তীতে জন স্মিটন (John Smeaton) লোহা গলানোর চুল্লি বা ব্লাস্ট ফার্নেস (Blast Furnace)-এর প্রযুক্তিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। বস্তুত খনিক্ষেত্রে ও ধাতুবিদ্যায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রভাবে কৃষিকাজ, সমরক্ষেত্র, যোগাযোগ, সেতু ও রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল।
(3) নৌ-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতি: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বিজ্ঞানচর্চার উন্নতি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পথ খুলে দেয়। ফলে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্ভব হয়। এই পর্বে আইবেরীয় উপদ্বীপের নাবিকেরা এক নতুন ধরনের জলযান প্রস্তুত করেন। এটি সম্ভবত আরবীয় ধৌ (Dhow) এবং চিনা জাঙ্ক (Junk) জলযানের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা এবং বৃহৎ বাণিজ্যের জন্য বৃহদাকার জাহাজ নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় প্রযুক্তিবিদরা ক্যারাক জাহাজ (Carrack Ship) নির্মাণ করেন। কামান ও আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত দ্রুতগামী এই জাহাজগুলি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। দিনির্ণয় যন্ত্র, একাধিক পাল ও দাঁড় সমন্বিত এই জাহাজগুলি সমুদ্রযাত্রাকে অনেকটাই নিরাপদ ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
(4) মুদ্রণ প্রযুক্তিতে অগ্রগতি: ইউরোপে পঞ্চদশ শতকের আগে পর্যন্ত মূলত হাতে লেখা পুথিরই প্রচলন ছিল। কিন্তু এই শতকের মাঝামাঝি সময়ে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার হয়। পাশাপাশি কাগজের প্রচলন, শিক্ষার প্রসার, নবজাগরণ-প্রসূত চেতনা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপের মুদ্রণশিল্পে আসে অভাবনীয় পরিবর্তন। মুদ্রণ প্রযুক্তির উন্নত ও আধুনিক উদ্ভাবন সর্বপ্রথম জার্মানিতে সম্পন্ন হয়েছিল এবং এই উদ্ভাবনের সঙ্গে জোহানেস গেনসফ্লিশ গুটেনবার্গ (Johannes Gensfleisch Zur Laden Zum Gutenberg)-এর নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কাঠের বদলে ধাতুর পুনর্ব্যবহারযোগ্য হরফ তৈরি করে গুটেনবার্গ মুদ্রণ জগতে বিপ্লব নিয়ে আসেন।
(5) সামরিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি: ইউরোপে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল সামরিক ক্ষেত্রেও। ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে বারুদ বা Gunpowder-এর। এর পরবর্তীতে পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে কামান ও বন্দুকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধের সময়ে ১৪টি বড়ো কামান, ২টি বিশালাকার কামান এবং ৩৫৬টি ছোটো কামান ব্যবহৃত হয়েছিল। পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছিল গোলন্দাজ বাহিনীর গুরুত্বও, যার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ইংল্যান্ড বনাম ফ্রান্সের শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের মাধ্যমে (১৩৩৭-১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ)। ষোড়শ শতকে মাস্কেট (Musket) বন্দুক নির্মিত হয়। এ ছাড়া এই সময় থেকে আগ্নেয়াস্ত্র তথা গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ত্রাস ইতালিয়ান (Trace Italienne) নামে নতুন ধরনের দুর্গ নির্মাণেও নজর দেওয়া হয়।
(6) চিকিৎসাশাস্ত্রে অগ্রগতি: প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় নানা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট (Daniel Gabriel Fahrenheit)-এর পারদ থার্মোমিটার, অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েনহক (Antonie Van Leeuwenhoek) কর্তৃক আবিষ্কৃত অনুবীক্ষণ যন্ত্র, রেনে লেনেক (Rene Laennec)-এর স্টেথোস্কোপ প্রভৃতি। *2
(7) বস্তুবয়ন শিল্পের উন্নতি: ইউরোপে যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ঘটেছিল তার প্রভাবে সপ্তদশ শতক ও তার পরবর্তীতে বস্ত্রবয়ন শিল্পে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। পূর্বে ঝুলন্ত টাকুর দ্বারা সুতো কাটা হত। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁতযন্ত্র রোলারের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর হারগ্রিভস (James Hargreaves) আবিষ্কার করেন স্পিনিং জেনি (Spinning Jenny), আর্করাইট (Arkwright) কর্তৃক উদ্ভাবিত হয় ওয়াটার ফ্রেম (Water Frame) যন্ত্র। পাশাপাশি কার্টরাইটের (E Cartwright) জলশক্তি চালিত তাঁত বয়নশিল্পে যুগান্তর আনে।
(8) জল ও বায়ুশক্তির ব্যবহার: দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে জলসেচ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। ফ্রান্সের আলের্সে বায়ুচালিত ও জলস্রোত চালিত জাঁতাকল দ্বারা শস্য পেষাই করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। পঞ্চদশ শতকে লেদ মেশিন, কাঠ চেরাই, পাথর চূর্ণ করা ইত্যাদি কাজ আয়ত্ত করে জলশক্তি ব্যবহারের প্রযুক্তি, এমনকি ইংল্যান্ড, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বায়ুকল বা Wind Mill-এর প্রযুক্তিকেও মানুষ কাজে লাগায়।
(9) অন্যান্য প্রযুক্তির উন্নতি: এই সময়ে বিভিন্ন ছোটো যন্ত্রপাতি নির্মাণের মধ্য দিয়েও প্রযুক্তিবিদ্যায় অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। আতস কাচ, চশমা, স্প্রিংচালিত ঘড়ি, পেন্ডুলাম ঘড়ি, বিভিন্ন যন্ত্রাংশের আবিষ্কার ইত্যাদির পিছনে প্রযুক্তির ভূমিকা ছিল সক্রিয়। সবশেষে বলা যায় যে, ইউরোপে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির প্রভাবে যেমন কৃষি, খনিজ, শিল্পের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনই বৃহত্তর ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হয়েছিল মানবসভ্যতা। সর্বোপরি প্রযুক্তির এই উন্নয়নের মধ্যেই যে আগামীর শিল্পবিপ্লবের বীজ নিহিত ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর