পঁচিশে বৈশাখ প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

১। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে লেখক বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অজরামর হয়ে থাকবেন তাঁর গানের জন্য। কোন্ কথা প্রসঙ্গে এবং কেন লেখক এরূপ মন্তব্য করেছেন বুঝিয়ে দাও।
উত্তর : প্রশ্নোদৃত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধটির লেখক হলেন রম্যরচনাকার সৈয়দ মুজতবা আলী। আলোচ্য প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ সাহচর্য তিনি পেয়েছিলেন বলেই ব্যক্তিগতভাবে তিনি কবিগুরুকে জানতেন, ফলে তাঁর সম্পর্কে লেখকের স্পষ্ট ধারণাও ছিল। এর পরেই লেখক কবিগুরুর সৃষ্টির মাহাত্ম নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য মহান স্রষ্টাদের সৃষ্টির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কথাও তুলে ধরেন। তখনই কবিগুরুর অমর সৃষ্টি গানের কথা প্রসঙ্গে লেখক প্রশ্নের মন্তব্যটি করেছেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী তরুণ বয়সে শান্তিনিকেতনে প্রবেশ করেন অধ্যয়নের জন্য। ক্রমে ক্রমে কবিগুরুর স্নেহধন্যও হয়ে ওঠেন তিনি। রবীন্দ্রসাহিত্য তথা রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি তিনি বিশেষভাবে মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন। আলোচ্য প্রবন্ধে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। লেখকের মতে ছোটোগল্প, প্রবন্ধসাহিত্য, নাট্যসাহিত্য, কাব্যসাহিত্য, শব্দতত্ত্বের গবেষক, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের অবদান বিশ্ববন্দিত। এমনকি রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনও একদিন বিশ্বজনের সুখময় নীড় হয়ে উঠবে কিন্তু এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথের সংগীত। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, ভাব, অভ্যন্তরীণ রসের আবেদন পাঠক তথা শ্রোতাকে এমন এক স্বর্গালোকে নিয়ে যায়-যা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে। রবীন্দ্রগানের মধ্যে যে ভাবাবেগ তা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। তাই লেখকের মন্তব্য রবীন্দ্রনাথ অজরামর হয়ে থাকবেন তাঁর গানের জন্য।
২। ‘এমন আর পড়িল না চোখে আমার যেমন আছে।’ ‘এমনটি’ বলতে লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন? উক্তিটির মধ্যে লেখকের যে মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর: প্রশ্নের উদ্ধৃতাংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে ‘এমনটি’ বলতে লেখক রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবরস তথা প্রাণ-মন মোহিত করা ভাবাবেগের কথা বলতে চেয়েছেন। লেখক বহুভাষাবিদ এবং বহু সাহিত্যিকের সাহিত্যরস তিনি আস্বাদন করেছেন; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানে যে সম্মোহনী আবেশ রয়েছে, তাতে লেখক এতটাই আবিষ্ট হয়েছেন যে, অন্য কারও গানেই তার সন্ধান তিনি পাননি। রবীন্দ্রগানের হৃদয়কে শান্ত-স্নিগ্ধ করা গীতিরসের কথা বোঝাতে গিয়েই লেখক ‘এমনটি’ শব্দের প্রয়োগ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে লেখক বলেন-“সুহৃদশান্তিদেব ঘোষ তাঁর ‘রবীন্দ্রসংগীতে’ এমন কোনো জিনিস বাদ দেননি যে সম্বন্ধে আপনি আমি আর পাঁচজনকে কিছু বলে দিতে পারি।” তাই লেখক রবীন্দ্রগানের সুরের দিক থেকে নয়, তিনি মুগ্ধ বিস্ময়ে ভাবেন যে, কতগুলি গুণের সমাবেশ ঘটলে এমন গান সৃষ্টি হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, ভাব, অভ্যন্তরীণ রসের আবেদন পাঠক, শ্রোতার মতোই লেখককেও এমন এক স্বর্গালোকে নিয়ে যায়, যা লেখককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। শেলি, কীট্স, গ্যোটে, কালিদাস, জয়দেব, গালীব প্রমুখদের কাব্য বা গানের রসাস্বাদনে লেখক তৃপ্ত হয়েছেন, নিজেকে ধন্য মেনেছেন; তবে সেখানে লেখক এমন গীতিরসের সন্ধান পাননি, যা তিনি রবীন্দ্রগানে অনুভব করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান এক অখন্ড রূপ নিয়ে হৃদয়মনকে আবির্ভূত করতে পারে, যেন এক অলৌকিক চেতনালোকে নিয়ে যায়, যা অন্য গানে পাওয়া যায় না। এভাবেই লেখকের মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে প্রশ্নের উদ্ধৃতাংশে।
৩। ‘তখন ধরা পড়ে: রবীন্দ্রনাথের গানের অখণ্ড, সম্পূর্ণ রূপ।’-বক্তার এই উক্তিটির ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশটিতে লেখক রবীন্দ্রনাথের গানের সম্পূর্ণতার প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে জার্মান ভাষায় রচিত ‘লীডার’ এবং ইরানীয়দের ‘গজল’ গানকে টেনে এনেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, ভাবাবেগ বা রসের আবেদন লেখককে অলৌকিক জগতে নিয়ে যায়। এই গান সমস্ত রূপ নিয়ে লেখকের হৃদয়-মনকে অভিভূত করে রাখে। রবীন্দ্রগানে এমন এক বিশেষত্ব আছে যা অন্যত্র পাওয়া যাবে না বলে লেখকের বিশ্বাস। আর এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক হার মেনেছেন বারবার। রবীন্দ্রগানের হৃদয়প্লাবি আকুলতায় সর্বপ্রকারের বিশ্লেষণ ক্ষমতা লোপ পায়। লেখকের মতে জার্মানরা যখন ‘লীডার’ অথবা ইরানীয়রা যখন ‘গজল’ গান, কেবল তখনই তিনি রবীন্দ্রসংগীতের মতো কিছুটা রসাস্বাদ তাতে পেয়েছেন। তবে ‘লীডার’ বা ‘গজল’ কোনোটিই সম্পূর্ণ নয়। এই গান যদি অনেকক্ষণ ধরে চলত তবে আরও ভালো লাগত, অর্থাৎ এরা অসম্পূর্ণ, আর অসম্পূর্ণ বলেই আরও কিছুক্ষণ ধরে তা চলতে পারত। রবীন্দ্রনাথের গান শোনার পরে লেখকের কখনোই এমন মনে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গান ধ্বনিপ্রধান এবং ব্যঞ্জনাময়। সেই গানের কথা, রসের আবেদন, ব্যঞ্জনার অতৃপ্তি দিয়ে হৃদয়-মনকে ভরিয়ে তোলে। তাই রবীন্দ্রগান অখণ্ড বা সম্পূর্ণ রূপ নিয়েই লেখকের হৃদয়-মনকে তৃপ্ত করেছে। এভাবেই লেখক বুঝিয়েছেন যে জার্মান ‘লীডার’ বা ইরানীয়দের ‘গজল’-এর সঙ্গে তুলনা করলে ধরা পড়বে রবীন্দ্রনাথের গানের অখণ্ড ও সম্পূর্ণ রূপ।
৪। ‘কোনো সন্দেহ নেই এরকম ধারাই হয়ে থাকে…।’-বক্তা কোন্ প্রসঙ্গে উক্তিটি করেছেন? কেমন ধারার কথা তিনি বলতে চেয়েছেন?
উত্তর: সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া আলোচ্য উদ্ধৃতাংশের বক্তা হলেন লেখক স্বয়ং। আলোচ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, সেই গান অখণ্ড অর্থাৎ সম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের গানের রসাবেশ এবং অনুভূতির গভীরতা অন্য কারও গানের মধ্যেই পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের গান কখনোই লেখকের মনে অসম্পূর্ণ বলে প্রতিভাত হয়নি। রবীন্দ্রগানের এমন অখণ্ডতার কথা প্রসঙ্গেই লেখক প্রশ্নে উদ্ধৃত কথাটি বলেছেন।
লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে যদি কখনও মনে হয় যে, সেই গান অতৃপ্ত করে গেছে, তবে তার কারণ রবীন্দ্রগানের অসম্পূর্ণতা নয়; তার কারণ হল অতিশয় উচ্চাঙ্গের রসসৃষ্টি মাত্রই ব্যঞ্জনা ও ধ্বনিপ্রধান। অর্থাৎ তা মনকে তৃপ্ত করে এবং ব্যঞ্জনার অতৃপ্তি দিয়ে হৃদয়-মনকে ভরিয়ে তোলে। গানের অন্তর্নিহিত ভাবাবেগ এবং রসের আবেদন শ্রোতা যদি অনুভব করতে না-পারেন, তবে তাকে অসম্পূর্ণ বলেই মনে হবে। রবীন্দ্রনাথের গান অতিশয় উচ্চাঙ্গের এবং ব্যঞ্জনাময় বলেই সেই গানের তান ও ধ্বনি হৃদয় ও মস্তিষ্কে অনন্য অনুভূতি সৃষ্টি করে মনকে আপ্লুত করে। তখন মনে হয় সেই গান শ্রোতার মনে যে ভুবন গড়ে দিল, প্রথম পরিচয়ে তার সবটা জানা না-হলেও দুঃখ নেই। বারবার করে শ্রবণ করলে সেই ভুবনের আরও অনেকটা শ্রোতার কাছে উদ্ভাসিত হবে, আর এমনভাবেই একদিন সেই ভুবন শ্রোতার নিতান্ত আপন হয়ে উঠবে। এমন ধারার কথাই লেখক বলতে চেয়েছেন।
৫। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধের লেখক রবীন্দ্রনাথের গানের প্রত্যেকটি শব্দকে কেন নটরাজের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গির মতো বলেছেন? কখন রবীন্দ্রনাথের গানকে ফিকে, পানসে বলে মনে হয়?
উত্তর: ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী খুব সহজসরল ভাষায় রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মকথা তথা সেই গানের হৃদয়প্লাবী আবেদন সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের সম্পূর্ণতা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক নটরাজের নৃত্যরত অবস্থার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিকে তুলনীয় করে তুলেছেন। লেখকের মতে, রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দচয়ন, সেই শব্দগুলিকে বিশেষ স্থানে সংস্থাপন এবং হৃদয়-মনকে কল্পনাতীতভাবে নতুন শব্দের ভিতর উন্মুখ রেখে ভাবে অর্থে মাধুর্যের পরিসমাপ্তিতে পৌঁছে দিয়ে গান যখন শেষ হয়, তখন মনে হয় এই গান অন্য কোনো রূপ নিতেই পারত না। এই প্রসঙ্গেই লেখক বলেছেন, নটরাজ যদি অন্য কোনো অঙ্গভঙ্গি নিয়ে আমাদের সামনে তার নৃত্যকে রূপায়িত করতে চাইতেন, তা তেমনভাবে আমাদের হৃদয়-মনকে মুগ্ধ করত না। এখানেই নটরাজের নৃত্যরত অঙ্গভঙ্গি এবং রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতিটি শব্দচয়ন সমানভাবেই সার্থক ও সম্পূর্ণ। এই কারণেই লেখক রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতিটি শব্দকে নটরাজের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গির মতো বলেছেন।
আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সম্মোহনী ক্ষমতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে, বহু গায়কেরই চমৎকার কণ্ঠ, সুর ও তালজ্ঞান থাকতেও তাদের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান স্বর্গীয় মাধুর্য লাভ করতে পারে না এবং সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রগান ফিকে বা পানসে বলে মনে হয়। লেখকের মতে রবীন্দ্রগানের কথা বা শব্দের অর্থের গভীরতা বা তাৎপর্য অনুভব করা দরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় গায়কের যথেষ্ট শব্দসম্মানবোধ নেই বলে, তিনি (গায়ক) প্রতিটি শব্দ রসিয়ে-বসিয়ে গাইছেন না। এ যেন নটরাজের প্রতিটি অঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে তাঁর নৃত্য বন্ধ হয়ে যাবার মতো ঘটনা। এমন ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের গানকে পানসে, ফিকে বলে মনে হয়।
৬। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে উল্লিখিত রবীন্দ্রনাথের গানের ‘হেথা মন্দমধুর কানাকানি জলে স্থলে শ্যামল মাটির ধরাতলে। হেথা ঘাসে ঘাসে রঙিন ফুলের আলিম্পন বনের পথে আঁধার-আলোয় আলিঙ্গন।’-এই অংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। প্রবন্ধের শেষাংশে ‘বিশ্বকর্মা মহাত্মা’ কথাটি কেন ব্যবহৃত হয়েছে?
উত্তর: রম্যরচনাকার, বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের প্রশ্নে উদ্ধৃত চরণগুলি ব্যবহার করেছেন। উক্ত চরণগুলির মাধ্যমে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন মর্ত্য পৃথিবীর প্রাণরসে পূর্ণ অনিন্দ্যসুন্দর শোভা স্বর্গের থেকেও মধুময় হয়ে উঠতে পারে। এই শ্যামল মাটির স্পর্শে শুধু নয়, জলে-স্থলেও লক্ষিত হয় মন্দমধুর আলাপচারিতা। এই ধরাতলের বনে-বনে, প্রকৃতিতে-প্রকৃতিতে, মানবে-মানবে অচ্ছেদ্য বন্ধনে সকলে সম্পৃক্ত। এখানে ঘাসে-ঘাসে, লতায়-পাতায় অঙ্কিত হয় রঙিন ফুলের আলপনা; আবার গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা ভূতলে পড়ে সৃষ্টি করে আলো-আঁধারি রূপ, কবিগুরু যাকে বলেছেন-বনের পথে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় আলো-আঁধার। উদ্ধৃত চরণগুলির মাধ্যমে মর্ত্যলোকের স্বর্গীয় সৌন্দর্যের অপরূপ চিত্রকে তুলে ধরেছেন কবিগুরু।
দেব বিশ্বকর্মা আপন সৃষ্টি-মাহাত্ম্যে অপরূপ ও অলৌকিক শিল্প সৃষ্টি করতে পারেন। সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রেও এমন কথাই প্রযোজ্য। ‘মাত্র কয়েকটি শব্দ আর একটুখানি সুর দিয়ে’ কবিগুরু তাঁর গানের মাধ্যমে এক অনাস্বাদিত ও অলৌকিক স্বপ্নলোক গড়ে তুলে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলেন গায়ক ও শ্রোতাকে। এমনটা করা সম্ভব কেবল মহাশিল্পীর পক্ষেই। তাই তো এমন গানের স্রষ্টা বিশ্বকর্মার সঙ্গেই তুলনীয়। এই কারণেই কবিগুরুর প্রতি সম্মানার্থে লেখক প্রবন্ধের শেষাংশে কবিগুরুকে উদ্দেশ্য করেই ‘বিশ্বকর্মা মহাত্ম্যা’ কথাটি ব্যবহার করেছেন।
৭। ‘আবার যখন তিনি আমাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন তখন এই মৃত্তিকাই স্বর্গের চেয়ে অধিকতর ‘মধুময় হয়ে ওঠে’।’-কোন্ প্রসঙ্গে লেখক এমন মন্তব্য করেছেন? মন্তব্যটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: রম্যরচনাকার, বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধে লেখক রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে সুললিত ভাষায় আলোচনা করেছেন। এই গান তানপ্রধান ও ব্যঞ্জনাময়। রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মবাণী গভীর উপলব্ধির। গানের প্রতিটি শব্দকে হৃদয়রসে সিঞ্চিত করে রসাবেশের মাধ্যমে অনুভব করতে হয়। রবীন্দ্রগান রসিক মনকে কখনও মৃত্তিকার বন্ধন থেকে নিয়ে যায় স্বর্গলোকে, আবার কখনও বিচরণ করায় এই মর্ত্যভূমিতে। এই প্রসঙ্গেই লেখক প্রশ্নের মন্তব্যটি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের সুর, লয়, তান, শব্দ সংস্থাপন, রসসৃষ্টি এমনই মনকে মুগ্ধ করে যে, তাতে ভেসে যায় রসিকের মন। তাই রবীন্দ্রগানের অলৌকিক রসসাগরে ভাসতে ভাসতে গায়ক বা শ্রোতা পৌঁছে যেতে পারেন অপ্রার্থিব জগতে। মর্ত্য পৃথিবীর বন্ধন ছিন্ন করে আমরা পৌঁছে যেতে পারি ‘নীলাম্বরের মর্মমাঝে’। আবার সেই গানই যখন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসে এই পৃথিবীতে তখন তা স্বর্গের থেকেও অধিকতর ‘মধুময় হয়ে ওঠে’। অর্থাৎ রসিকমন রবীন্দ্রগানের তরিতে ভাসতে ভাসতে কল্পনা করে-
"ঐ আলোক-মাতাল স্বর্গসভার মহাঙ্গন, কোথায় ছিল কোন্ যুগে মোর নিমন্ত্রণ।”
যখন রসিক সেই স্বর্গসভার অভিজ্ঞতালাভের জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকেন, তখনই গগনতল ত্যাগ করে ফিরে আসতে হয় মর্ত্য পৃথিবীতে। আর তখন রসিক উপলব্ধি করেন স্বর্গলোক নয়, এই মর্ত্যভূমিই অধিকতর মাধুর্যময় হয়ে স্থান করে নিয়েছে তাঁর বোধের জগতে। প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যের মাধ্যমে লেখক এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
৮। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে সৈয়দ মুজতবা আলী গান ছাড়া রবীন্দ্রনাথের অন্য কোন্ কোন্ গুণের উল্লেখ করেছেন? তাঁর কাছে কবির গান অসম্পূর্ণরূপে প্রতিভাত হয় না কেন?
উত্তর: রবীন্দ্রস্নেহধন্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেও প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি কবিগুরুর অন্যান্য সৃষ্টির সন্ধান দিয়েছেন আমাদের। কবিগুরু যেমন ঔপন্যাসিক রূপে সুপ্রসিদ্ধ, তেমনই তিনি ছোটোগল্পে ফরাসি সাহিত্যিক মপাসাঁ, রুশ নাট্যকার ও ছোটোগল্পকার চেখফকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। নাট্যসাহিত্যে যে-কোনো মিস্টিকের সঙ্গে তুলনা করা যায় তাঁর নাটককে। কবি রূপে তো তিনি বিশ্বজনের কাছেই প্রশংসিত। শব্দতত্ত্বে তাঁর পাণ্ডিত্য, মত্যদ্রষ্টারূপে তাঁর ব্যাখ্যা বা রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় তিনি নব নব শিক্ষা দিয়েছেন। গুরুরূপে তাঁর নির্মিত শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধ ছায়ায় বিশ্বজন শান্তি খুঁজে পান। অর্থাৎ আলোচ্য প্রবন্ধে গান ছাড়াও কবিগুরুর ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, নাট্যকার, শব্দতত্ত্বের গবেষক, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সত্যদ্রষ্টা প্রভৃতি গুণের উল্লেখ রয়েছে।
রবীন্দ্রগান কখনোই লেখকের হৃদয়ে অসম্পূর্ণ রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়নি। যদি কখনও মনে হয় সেই গান মনকে অতৃপ্ত রেখে গেল, তার কারণ সেই গানের অসম্পূর্ণতা নয়, তা অতিশয় উচ্চাঙ্গের বলেই এমন হয়। গানের অন্তর্নিহিত ভাবাবেগ, রসের আবেদন যদি শ্রোতা অনুভব করতে না-পারেন, তবেই তা অসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। যেহেতু রবীন্দ্রনাথের গান অতিশয় উচ্চাঙ্গের এবং ব্যঞ্জনাময়; তাই সেই গানের তান বা ধ্বনি হৃদয় ও মস্তিষ্কে অনন্য অনুভূতি সৃষ্টি করে ব্যঞ্জনার অতৃপ্তি দিয়ে হৃদয়-মন ভরিয়ে তোলে। লেখকের মতে, রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দচয়ন, সেই শব্দগুলিকে বিশেষ স্থানে সংস্থাপন এবং হৃদয়-মনকে কল্পনাতীতভাবে নতুন শব্দের ভিতর উন্মুখ রেখে ভাবে, অর্থে, মাধুর্যের পরিসমাপ্তিতে পৌঁছে দিয়ে গান যখন শেষ হয়, তখন মনে হয় এই গান অন্য কোনো রূপ নিতেই পারত না। এই গান গায়ক ও শ্রোতার মনে নতুন ভুবন সৃষ্টি করে। এই কারণেই কবিগুরুর গান লেখকের কাছে কখনোই অসম্পূণরূপে প্রতিভাত হয় না।
৯। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
উত্তর: সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল নামকরণ। নামকরণের মাধ্যমে রচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগাম ধারণা করা যায়। নাকরণ নানা প্রকারের হয়, যেমন-চরিত্রপ্রধান, ঘটনাকেন্দ্রিক, ব্যঞ্জনাধর্মী ইত্যাদি। এবার আলোচনা করে দেখা যাক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধের নামকরণ কতটুকু সার্থক হয়েছে।
লেখক প্রবন্ধটি শুরুই করেছেন কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ হৃদ্যতার পরিচয় দিয়ে। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগে যৌবনেই তিনি কবিগুরুর সংস্পর্শে আসেন এবং কবিগুরু সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এই কথার সূত্রেই লেখক আলোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের শিল্প সৃষ্টি উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক, কাব্য, শব্দতত্ত্ব, সংগীত, রাজনীতি প্রভৃতি ৪ বহুধারায় ছড়িয়ে পড়েছে এই জগতে আর তাতে মুগ্ধ হয়েছেন রসিকজন।
রবীন্দ্রনাথের অতুলনীয় সৃষ্টি হল তাঁর গান, যা তাঁকে জগৎসংসারে শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মার সঙ্গে তুলনীয় করে তুলেছে বলে লেখক মনে করেছেন। রবীন্দ্রগানের আলোচনায় শেলি, কীট্স, গ্যোটে, কালিদাস, জয়দেব, গালীব প্রমুখের প্রসঙ্গ তুলে লেখক বলেছেন-এঁদের গানে তিনি তৃপ্তি পেলেও, রবীন্দ্রগানের স্বর্গীয় গীতিরস এঁদের গানে নেই। আবার জার্মান ‘লীডার’ বা ইরানীয়দের ‘গজল’-ও অসম্পূর্ণ বলেছেন, কারণ তা মনকে অতৃপ্ত রাখে; কিন্তু রবীন্দ্রগান অখণ্ড ও সম্পূর্ণ। এই গান অতিশয় উচ্চাঙ্গের এবং রসিকজনের হৃদয়ে নতুন ভুবন সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রগানের রসসাগরে ভেসে মর্ত্যপৃথিবীর বন্ধন ছিন্ন করে গায়ক বা শ্রোতা পৌঁছে যান ‘নীলাম্বরের মর্মমাঝে’; আবার – সেই গানই যখন রসিককে ফিরিয়ে আনে মর্ত্যভূমিতে, তখন তা হয়ে ওঠে – স্বর্গের থেকেও মাধুর্যময়।
এবার প্রশ্ন হতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে প্রবন্ধটির নামকরণ ‘পঁচিশে বৈশাখ’-এর সম্পর্ক কী? আমাদের মনে রাখা দরকার ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ আর ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কথা দুটি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হয়ে আছে। আর তাই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারের কথা উঠলেই – কবিগুরুর জন্মদিনটির কথাও চলে আসে স্বাভাবিকভাবেই। ‘পঁচিশে বৈশাখ’-এ তো আমরা রবীন্দ্রসৃষ্টি তথা রবীন্দ্রনাথের গানেই কবিগুরুকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি। তাই আমরা বলতে পারি আলোচ্য প্রবন্ধে একবারের জন্যও ‘পঁচিশে বৈশাখ’ দিনটির কথা না-লেখা থাকলেও নামকরণে ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামটি যথেষ্ট ব্যঞ্জনাময় ও সার্থক হয়ে উঠেছে।
১। ‘তিনি বিশ্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছেন,’ -উক্তিটির মাধ্যমে বক্তার কীরূপ মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে?
উত্তর: সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছেন।
কবিগুরুর আহ্বানে তরুণ বয়সে সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পদার্পণ করেন এবং তিনি সেখানে অধ্যয়নও করেন। ফলে তিনি কবিগুরুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং সেই কারণে কবিগুরু সম্পর্কে তাঁর গভীর আত্মীয়তার মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে আলোচ্য প্রবন্ধে। বক্তার মতে সাহিত্যের নানা শাখায় রবীন্দ্রনাথের স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। যেমন কবিগুরু উত্তম উপন্যাস লিখেছেন, ছোটোগল্পে তিনি ফরাসি সাহিত্যিক মপাসাঁ এবং রুশ সাহিত্যিক চেখফকে ছাড়িয়ে গেছেন। বিশ্বজনের কাছে তিনি বন্দিত হয়েছেন কবিরূপে। বক্তার কথার মাধ্যমে কবিগুরুর প্রতি যে তাঁর অকৃত্তিম শ্রদ্ধা এবং অনুরাগ ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়।
২। ‘রবীন্দ্রনাথ এসব উত্তীর্ণ হয়ে অজরামর হয়ে রইবেন তাঁর গানের জন্য।’-প্রসঙ্গসহ উক্তিটির তাৎপর্য লেখো।
উত্তর: সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধে প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে উক্তিটি করেছেন।
লেখকের মতে ছোটোগল্প, প্রবন্ধসাহিত্য, নাট্যসাহিত্য, কাব্যসাহিত্য, শব্দতত্ত্বের গবেষক, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের অবদান বিশ্ববন্দিত। এমনকি রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন একদিন বিশ্বজনের সুখময় নীড় হয়ে উঠবে কিন্তু এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথের সংগীত। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, ভাব, অভ্যন্তরীণ রসের আবেদন পাঠক তথা শ্রোতাকে এমন এক স্বর্গালোকে নিয়ে যায়-যা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে – তোলে। রবীন্দ্রগানের মধ্যে যে ভাবাবেগ তা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। – তাই লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথ অজরামর হয়ে থাকবেন তাঁর গানের জন্য।
৩। ‘তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বার বার হার মেনেছি।’-‘তার কারণ’ বলতে কীসের কারণ-তার উল্লেখ করে উক্তিটির তাৎপর্য লেখো।
উত্তর: প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি সৈয়দ মজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে ‘তার কারণ’ বলতে রবীন্দ্রনাথের গানের • রসাবেগ তথা গীতিরসের কথা বলা হয়েছে।
লেখক রবীন্দ্রনাথের গানে মুগ্ধ প্রাণ। নানা গুণের সমাবেশ ঘটেছে রবীন্দ্রসংগীতে। শেলি, কীট্স, গ্যোটে, কালিদাস, জয়দেব, গালীব প্রমুখদের কাব্য বা গানের রসাস্বাদ করে লেখক মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেছেন। কিন্তু সেখানে লেখক সেই গীতিরসের সন্ধান পাননি, যা তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে পেয়েছেন। রবীন্দ্রগান এক অখণ্ড রূপ নিয়ে হৃদয়-মনকে অভিভূত করে ফেলতে পারে। এর ফলে গানের রূপ-রস-ভাবাবেগ বা কাব্যগুণকে বিশ্লেষণ করার মতো ক্ষমতা থাকে না। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের গানে লেখক এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন, যা তাকে যেন এক অপ্রার্থিব চেতনালোকে নিয়ে যায়। উক্তিটির মাধ্যমে লেখক এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
৪। ‘অতিশয় উচ্চাঙ্গের রসসৃষ্টি মাত্রই ব্যঞ্জনা এবং ধ্বনিপ্রধান।’-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মন্তব্যটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি নেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের সম্পূর্ণতা প্রসঙ্গে লেখক উক্ত বক্তব্যটি করেছেন।
লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথের গানের অখণ্ড ও সম্পূর্ণ রূপ ধরা পড়ে জার্মান লীডার বা ইরানীয় গজলের সঙ্গে তুলনা করলে। লীডার বা গজল মনকে তৃপ্ত করে ঠিকই কিন্তু তারাও সম্পূর্ণ নয়। রবীন্দ্রনাথের গান তা নয়, রবীন্দ্রগান কখনোই লেখকের হৃদয়ে অসম্পূর্ণ রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়নি। যদি কখনও মনে হয় সেই গান মনকে অতৃপ্ত রেখে গেল, তার কারণ সেই গানের অসম্পূর্ণতা নয়, তা অতিশয় উচ্চাঙ্গের বলেই এমন হয়। গানের অন্তর্নিহিত ভাবাবেগ, রসের আবেদন যদি শ্রোতা অনুভব করতে না-পারেন, তবেই তা অসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। যেহেতু রবীন্দ্রনাথের গান অতিশয় উচ্চাঙ্গের এবং ব্যঞ্জনাময়; তাই সেই গানের তান বা ধ্বনি হৃদয় ও মস্তিষ্কে অনন্য অনুভূতি সৃষ্টি করে ব্যঞ্জনার অতৃপ্তি দিয়ে হৃদয়-মন ভরিয়ে তোলে।
৫। ‘সে ভুবন আমার নিতান্ত আপন হয়ে উঠবে।’-কোন্ ভুবন কীভাবে আপন হয়ে উঠবে বলে লেখকের ধারণা?
উত্তর: প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি সৈয়দ মজুতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে ‘সে ভুবন’ বলতে রবীন্দ্রনাথের গান লেখকের হৃদয়ে যে স্বপ্নময় ভুবন তৈরি করেছে, তাকেই বুঝিয়েছেন লেখক।
লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথের গান অতি উচ্চাঙ্গের, তা ব্যঞ্জনা ও ধ্বনিপ্রধান। এই গান ব্যঞ্জনার অতৃপ্তি দিয়ে হৃদয়-মনকে ভরিয়ে তোলে। তাই প্রথম পরিচয়ে রবীন্দ্রগান দ্বারা সৃষ্ট ভুবনের সবটা পরিচয় পাওয়া বা অনুভব করা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ গভীর রসবোধ বা ভাবাবেগ না-থাকলে সেই ভুবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া যায় না। তবে তাতে খেদ থাকা উচিত নয়। বার বার শ্রবণ করলে সেই ভুবনের অনেকখানি উদ্ভাসিত হয়, তখন তার পরিচয় পাওয়া অনেকটা সুবিধাজনক হয়। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের গানের ভুবন লেখকের কাছে নিতান্ত আপন হয়ে উঠবে।
৬। ‘নটরাজের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গির মত রবীন্দ্রনাথের গানের প্রত্যেকটি শব্দ।’-বক্তার উল্লেখসহ উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য লেখো।
উত্তর: প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্তিটির বক্তা হলেন লেখক নিজে।
রবীন্দ্রনাথের গানের সম্পূর্ণতা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক নটরাজের নৃত্যরত অবস্থার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিকে তুলনীয় করে তুলেছেন। লেখকের মতে, রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দচয়ন, সেই শব্দগুলিকে বিশেষ স্থানে সংস্থাপন এবং হৃদয়-মনকে কল্পনাতীতভাবে নতুন শব্দের ভিতর উন্মুখ রেখে ভাবে অর্থে মাধুর্যের পরিসমাপ্তিতে পৌঁছে দিয়ে গান যখন শেষ হয়, তখন মনে হয় এই গান অন্য কোনো রূপ নিতেই পারত না। এই প্রসঙ্গেই লেখক বলেছেন, নটরাজ যদি অন্য কোনো অঙ্গভঙ্গি নিয়ে আমাদের সামনে তার নৃত্যকে রূপায়িত করতে চাইতেন, তা তেমনভাবে আমাদের হৃদয়-মনকে মুগ্ধ করত না। এখানেই নটরাজের নৃত্যরত অঙ্গভঙ্গি এবং রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতিটি শব্দচয়ন সমানভাবেই সার্থক ও সম্পূর্ণ। উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে লেখক এ কথাই বলতে চেয়েছেন।
৭। ‘তাই যেন নটরাজের প্রতিটি অঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে তাঁর নৃত্য বন্ধ হয়ে গেল।’- প্রসঙ্গসহ উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর: প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের সম্পূর্ণতা এবং নটরাজের অঙ্গভঙ্গির সঠিক রূপায়ণ প্রসঙ্গে লেখক উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।
আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, চমৎকার সুর-তাল-জ্ঞান, মধুরতম কণ্ঠ থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো গায়কের কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান পানসে বা ফ্লাট বলে মনে হয়। এর কারণ হল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁদের শব্দসম্মান বোধ নেই। প্রতিটি শব্দকে রসিয়ে বসিয়ে না-গাওয়ার ফলেই গান মর্মলোকে অনাস্বাদিত অনুভূতি জাগাচ্ছে না। গায়কি বড়ো আড়ষ্ট বলে মনে হয় তখন। ঠিক নটরাজের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি যদি সহজাত এবং স্বতঃস্ফূর্ত না-হত, তবে তা আড়ষ্ট হয়ে নৃত্য বন্ধ হয়ে যেত। রবীন্দ্রগানের শব্দজ্ঞান বিগর্হিত গায়কের গানও তেমনই অসম্পূর্ণ। উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে লেখক এ কথাই বলতে চেয়েছেন।
৮। ‘তারায় তারায় দীপ্তশিখার অগ্নি জ্বলে/নিদ্রাবিহীন গগনতলে-‘-প্রসঙ্গসহ উদ্ধৃতাংশের ব্যাখ্যা দাও।
উত্তর: বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতাংশটি নেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গান রসিক মনকে কখনও স্বর্গীয় লোকে আবার কখনও মর্ত্যলোকে বিচরণ করায়। সেই প্রসঙ্গেই লেখক উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছেন।
প্রশ্নের উদ্ধৃতিটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের দুটি ছত্র। রবীন্দ্রনাথের সুর, লয়, তান, শব্দ সংস্থাপন, রসসৃষ্টি এমনই মনকে মুগ্ধ করে যে, তাতে ভেসে যায় রসিকের মন। তাই রবীন্দ্রগানের অলৌকিক রসসাগরে ভাসতে ভাসতে গায়ক বা শ্রোতা পৌঁছে যেতে পারেন অপ্রার্থিব জগতে। মর্ত্য পৃথিবীর বন্ধন ছিন্ন করে আমরা পৌঁছে যেতে পারি ‘নীলাম্বরের মর্মমাঝে’। আবার সেই গানই যখন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসে এই পৃথিবীতে তখন তা স্বর্গের থেকেও অধিকতর ‘মধুময় হয়ে ওঠে’। উদ্ধৃতাংশটির মাধ্যমে গগনতল ত্যাগ করে মর্ত্য পৃথিবীতে ফিরে আসার কথাই ধ্বনিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গান এমনই রসাবেসে আমাদের বিভোর করে রাখে।
৯। ‘তারপর এ-ধরার কি অপরূপ বর্ণনা’-‘তারপর’ বলতে কার পরের কথা বলা হয়েছে এবং ‘তারপর’-এর বর্ণনাটা কীরূপ?
উত্তর: প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রগানের ভাবরসে মগ্ন লেখক যখন রবীন্দ্রগানের তরীতে ভর করে নীলাম্বরের মর্মমাঝে বিচরণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত করেছেন, হঠাৎই আবার সেই গানই লেখককে নিয়ে আসে মর্ত্যমাঝারে। ‘তারপর’ বলতে এই সময়কেই ইঙ্গিত করেছেন লেখক।
স্বর্গালোকে বিচরণের আকাঙ্ক্ষা অসমাপ্ত রেখেই রবীন্দ্রসংগীত রসিক ফিরে আসেন মর্ত্যলোকে। এখানকার অলৌকিক শোভা প্রত্যক্ষ করেন। লক্ষ করেন এই পৃথিবীর শ্যামল মাটির স্পর্শে শুধু নয়, জলে-স্থলে সর্বত্র মন্দ-মধুর আলাপচারিতা, বনে-বনে, মানবে-মানবে, প্রকৃতিতে-প্রকৃতিতে অচ্ছেদ্য বন্ধনে সম্পৃক্ত সকলে। এখানে ঘাসে-ঘাসে, লতায়-পাতায় রঙিন ফুলের আলপনা অঙ্কিত হয়; আবার বনের পথে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় আলো-আঁধার। তাই এই মর্ত্যলোকেই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের আস্বাদ অনুভব করেন কবিগুরু। এভাবেই কবিগুরু এই ধরাতলের অপরূপ বর্ণনা দিয়েছেন প্রশ্নোদ্ভূত গানের কলিতে।
১০। ‘এ অলৌকিক কর্ম যিনি করতে পারেন তিনিই ‘বিশ্বকর্মা মহাত্মা”-উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর: প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মর্মবাণী তথা সেই গানের হৃদয়প্লাবী মোহমুগ্ধতা প্রসঙ্গে লেখক প্রশ্নের উক্তিটি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের গানে রসিক শ্রোতা এবং গায়ক ভাবরসের দ্বারা এতটাই আপ্লুত হন যে, সেই গানের ভেলায় সওয়ার হয়ে তারা সহজেই স্বর্গে-মর্ত্যে যে-কোনো ভুবনে বিচরণ করতে পারেন। আপনার অজান্তেই এরূপ আনাগোনা চলতে থাকে। উক্ত গানে মাত্র কয়েকটি শব্দ এবং সামান্য একটু সুর দিয়ে কখনও মানুষকেই দেবতা বানায় আবার তাকেই কখনও দেবতার থেকেও মহত্তর মানুষ করে তোলে। স্বয়ং বিশ্বকর্মা আপন সৃষ্টির মাহাত্ম্যে অপরূপ ও অলৌকিক শিল্পসৃষ্টি করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের গানেও এই কথাটি প্রযোজ্য। সামান্য কয়েকটি কথা ও সুরের ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথের গান এক অনাস্বাদিত ও অলৌকিক স্বপ্নলোক গড়ে তুলে গায়ক ও শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। এতো এক মহাশিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। তাই তো এমন গানের স্রষ্টা বিশ্বকর্মার সঙ্গে তুলনীয়।
১। ‘সহৃদয়া পাঠিকা অপরাধ নেবেন না।’-কে, কোন্ প্রসঙ্গে উক্তিটি করেছেন?
উত্তর: ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছেন।
লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ছিলেন। কবিগুরুর শান্তিনিকতনেও বহুবার গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সেই কারণেই কবিগুরুর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন। ফলে ব্যক্তিগতভাবে কবিগুরুর সম্পর্কে জানাশোনা বা ধারণাও তার ছিল। সেই ধারণা বা জ্ঞান থেকেই লেখক যদি কবিগুরুকে দেখেন, তাতে পাঠক-পাঠিকাগণ মনক্ষুণ্ণ হবেন না হয়তো-এই প্রসঙ্গেই লেখক উক্তিটি করেছেন।
২। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে লেখক কীসের বা কাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের তুলনা করেছেন?
উত্তর: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী বিশ্বের বিভিন্ন সাহিত্য তথা সাহিত্যিকদের সৃষ্টির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসৃষ্টিকে তুলনা করেছেন। যেমন-রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য সৃষ্টি ছোটোগল্প। সেক্ষেত্রে তিনি ফরাসি সাহিত্যিক মপসাঁ এবং রুশ নাট্যকার তথা সাহিত্যিক চেখফকেও অতিক্রম করে গেছেন। নাটক, কাব্য, শব্দতত্ত্ব ইত্যাদিতেও তিনি বিশ্বের যে-কোনো সাহিত্যশিল্পীর সঙ্গেই তুলনীয়।
৩। ‘সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই।’-লেখক কোন্ বিষয়ের কথা বলতে চেয়েছেন?
উত্তর: ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গে বলার সময় শান্তিনিকেতনের উল্লেখ করেন। লেখকের মতে কবিগুরু প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের ‘স্নিগ্ধ-ছায়ায় বিশ্বজন একদিন সুখময় নীড় লাভ করবে।’ এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই বলে লেখকের ধারণা। এই বিষয়ের কথাই লেখক বলতে চেয়েছেন।
8। ‘আমার কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাস,’-লেখকের কী বিশ্বাস?
উত্তর: ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্প-সাহিত্য, সত্য দর্শন, রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পর্কে দ্বিধাহীন ভাষায় প্রশংসা করেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন যে আগামীতে বিশ্বমানবের শান্তির নীড় হতে চলেছে, সে কথাও বলেছেন লেখক। তবু লেখকের বিশ্বাস হল-এই সব কিছুকে ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথ অজরামর হয়ে থাকবেন তাঁর গানের জন্য।
৫। ‘সুরের দিক দিয়ে বিচার করব না।’-কে, কেন এ কথা বলেছেন?
উত্তর: প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্তিটির বক্তা লেখক নিজেই।
আলোচ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের সংগীত সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন-সুহৃদ শান্তিদেব ঘোষ তাঁর রবীন্দ্রসংগীতে এমন কোনো জিনিস বাদ দেননি যে, সেই সম্পর্কে অন্যদের আর কিছু বলার থাকতেই পারে না। এই কারণেই লেখক প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছেন।
৬। আমি বিচার করছি,’- ‘আমি’ কে এবং তিনি কী বিচার করছেন?
উত্তর: আলোচ্য অংশে ‘আমি’ বলতে ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধের লেখক রম্যরচনাকার সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীকে বোঝানো হয়েছে।
রবীন্দ্রসংগীতের আলোচনায় সুরের প্রসঙ্গে লেখক কোনো বিচার করতে চান না; লেখক শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে ভাবেন বা বিচার করতে চান যে, কতগুলি অপূর্ব গুণের সমন্বয় হলে রবীন্দ্রনাথের এমন গান সৃষ্টি হতে পারে!ল
৭। ‘এমনটি আর পড়িল না চোখে,/আমার যেমন আছে!’ -উক্তিটির প্রসঙ্গ লেখো।
উত্তর: সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে আলোচ্য উক্তিটি ব্যবহার করেছেন। লেখক শেলি, কীট্স, গ্যোটে, হাইনে, কালিদাস, গালীব প্রমুখ খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানের রসাস্বাদের তুলনা প্রসঙ্গে উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন। লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথের গানে যে গীতিরস তিনি আস্বাদন করেছেন, তা অন্যদের কাব্যে বা গানে অনুপস্থিত।
৮। কীসের সঙ্গে, কেন রবীন্দ্রনাথের গানের তুলনা করা যায় বলে প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী মনে করেন?
উত্তর: ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন জার্মানদের গান ‘লীডার’ এবং ইরানীয়দের ‘গজল’ গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের তুলনা করা যায়।
রবীন্দ্রনাথের গান অখণ্ড রূপ নিয়ে হৃদয়-মন অভিভূত করে। কেবল জার্মান ‘লীডার’ এবং ইরানীয়দের ‘গজল’ গানেই লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী রবীন্দ্রসংগীত জাতীয় কিঞ্চিৎ রস আস্বাদন করতে পারেন। তাই লেখক প্রশ্নোদ্ভূত কথাটি বলেছেন।
৯। ‘অসম্পূর্ণ বলেই মনে হয়েছে’-কাকে, কেন অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়েছে?
উত্তর: সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর মনে হয়েছে জার্মান ভাষায় রচিত গান ‘লীডার’ এবং ইরানীয়দের ‘গজল’ গান অসম্পূর্ণ।
‘লীডার’ ও ‘গজল’ শুনে লেখকের মনে হয়েছে এই গানগুলি যদি অনেকক্ষণ ধরে চলত তবে আরও ভালো লাগত। কারণ সময় স্বল্পতার কারণেই ওই গান লেখকের মনকে অতৃপ্ত রেখে গেছে। তাই লেখকের উক্ত গানকে অসম্পূর্ণ হয়েছে।
১০। ‘রবীন্দ্রনাথের গান কখনোই অসম্পূর্ণরূপে আমার সামনে দাঁড়ায়নি।’-কে, কোন্ প্রসঙ্গে উক্তিটি করেছেন?
উত্তর: প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্তিটির বক্তা হলেন স্বয়ং প্রাবন্ধিক।
জার্মান সংগীত ‘লীডার’ বা ইরানীয় গজলের সুর-তালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের তুলনা প্রসঙ্গেই বক্তা উক্তিটি করেছেন। বক্তার মনে হয়েছে লীডার বা গজল তাঁকে মুগ্ধ করলেও সেগুলি অসম্পূর্ণ; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান সম্পূর্ণ-এই আলোচনা প্রসঙ্গেই তিনি (বক্তা) প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছেন।
১১। ‘কিন্তু খেদ নেই’-খেদ নেই কেন?
উত্তর: অপ্রাপ্তিজনিত মনোবেদনা বা দুঃখ হল খেদ। রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী উক্তিটি করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর সামনে যে ভুবন গড়ে দিয়েছে তার প্রথম পরিচয়ে সেই গানের সকল ব্যঞ্জনা অনুভব করতে না-পারলেও তাঁর ‘খেদ’ নেই। কারণ পুনরায় সেই গান শ্রবণ করলেই অজানা ভুবনের অনেকটাই তাঁর কাছে উদ্ভাসিত হবে বলে তিনি মনে করেন।
১২। ‘আরেকটি কথা তার চেয়েও সত্য:’- উক্তিটির উৎস লিখে ‘সত্য’-টি বিবৃত করো।
উত্তর: প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটির উৎস হল সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধ।
আলোচ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সম্পূর্ণতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক (বক্তা) যে ‘সত্য’-টিকে তুলে ধরেছেন, তা হল- ‘রবীন্দ্রনাথের কোনো গানই কখনো নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে না।’
১৩। ‘গজল’ কী?
উত্তর: ভারতীয় সংগীতের হিন্দুস্তানি ধারার অন্তর্গত হল গজল গান। ভারতে গজল সংগীতের জনক হলেন আমির খসরু। ‘গজল’ একপ্রকার লঘু সংগীত। পারস্য দেশেই গজল গানের উৎপত্তি। পারস্য সংগীতের প্রভাব ভারতীয় সংগীতে পড়লে, এদেশে গজলের অনুপ্রবেশ ঘটে। হৃদয়-মনকে আপ্লুত করার এক বিশেষ গুণ গজল গানে থাকে বলে এই গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একজন উল্লেখযোগ্য গজল রচনাকার হলেন মীর্জা গালিব।
১৪। ‘প্রতিবারই হৃদয়ঙ্গম করি’-কে, কী হৃদয়ঙ্গম করেন?
উত্তর: হৃদয়ঙ্গম করেন ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধের রচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলী। রবীন্দ্রনাথের গান ভাবে, অর্থে, মাধুর্যের পরিসমাপ্তিতে রসিকমনকে পৌঁছে দিয়ে গান যখন শেষ হয়, তখন লেখক প্রতিবারই হৃদয়ঙ্গম করেন যে, সেই গান আর অন্য কোনো রূপ নিতে পারত না।কত্ব
১৫। ‘এ গান আর অন্য কোনো রূপ নিতে পারতো না’-বক্তার কখন এমন মনে হয়েছে?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের গানের সম্পূর্ণতা প্রসঙ্গে ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি প্রশ্নের উক্তিটি করেছেন। লেখকের মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দচয়ন, সেই শব্দগুলিকে বিশেষ স্থানে সংস্থাপন এবং হৃদয়-মনকে কল্পনাতীত নতুন শব্দের ভিতর দিয়ে উন্মুখ রেখে ভাবে, অর্থে, মাধুর্যের অন্তিমে পৌঁছে দিয়ে গান যখন শেষ হয় তখনই প্রতিবার লেখকের মনে হয়েছে উক্ত গান আর অন্য কোনো রূপ নিতে পারত না। ভাবি নাই
১৬। ‘তাই বলি’-বক্তা কোন্ প্রসঙ্গে কী বলেন?
উত্তর: ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গে বলেছেন। বক্তা বলেছেন-নটরাজের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গির মতোই রবীন্দ্রনাথের গানের প্রত্যেকটি শব্দ। অর্থাৎ নটরাজ যেমন অন্য কোনো অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বক্তার সামনে তাঁর নৃত্যকে রূপায়িত করতে পারতেন না, তেমনই রবীন্দ্রনাথের গানেও অন্য শব্দ যোজনা করলে তা এমনভাবে হৃদয়ের পক্ষে প্রীতিকর হয়ে উঠত না বলেই বক্তার মনে হয়েছে।
১৭। ‘কোনো কোনো গায়কের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান ফিকে, পানসে অর্থাৎ ফ্লাট বলে মনে হয়।’-উদ্ধৃতাংশের উৎস লিখে, উক্তিটির কারণ লেখো।
উত্তর: প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটির উৎস হল সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধ।
আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক রবীন্দ্রনাথের গানের সম্মোহনী ক্ষমতার কথা বলেছেন। লেখকের মতে অনেক গায়ক চমৎকার সুর, তাল, জ্ঞান, মধুরতম কণ্ঠ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাইলেও তা ফিকে, পানসে বলে মনে হয়। এর কারণ হিসেবে লেখকের অভিমত এই গায়কগণের যথেষ্ট শব্দসম্মান বোধ নেই, প্রতিটি শব্দকে রসিয়ে বসিয়ে গাইছেন না, আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে তাঁদের গানের অঙ্গগুলি, তাই লেখক প্রশ্নোদ্ভূত কথাটি বলেছেন। সামাি
১৮। ‘স্বর্গের চেয়ে অধিকতর ‘মধুময় হয়ে ওঠে।”-কোন্ প্রসঙ্গে উক্তিটি করা হয়েছে?
উত্তর: ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী উক্তিটি করেছেন। লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথের গান যেন মৃত্তিকার বন্ধন থেকে আমাদের নিয়ে যায় নীলাম্বরের মর্মমাঝে অর্থাৎ স্বর্গীয় সুষমায়। আবার সেই গানই যখন আমাদের নিয়ে আসে মর্ত্যমানবের মাঝে, তখন এই মৃত্তিকাই অধিকতর মধুময় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রগানের এমন হৃদয়প্লাবী মোহমুগ্ধতা প্রসঙ্গেই লেখক প্রশ্নের উক্তিটি করেছেন।
১৯। ‘হেথা মন্দমধুর কানাকানি জলে স্থলে’-উদ্ধৃতাংশটির অর্থ লেখো।
উত্তর: উদ্ধৃতাংশটির রচয়িতা হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানে ‘হেথা’ বলতে মর্ত্য পৃথিবীর কথা বলা হয়েছে। এই পৃথিবীর জলে-স্থলে অর্থাৎ সমগ্র প্রকৃতিতে তথা জীবজগতে মন্দ-ভালোয় মিলে-মিশে ঘটছে নানা ঘটনা।
২০। ‘এ অলৌকিক কর্ম যিনি করতে পারেন’-কে, কোন্ অলৌকিক কর্ম করতে পারেন?
উত্তর: যিনি ‘বিশ্বকর্মা মহাত্মা’ তিনি অলৌকিক কর্ম করতে পারেন। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে সৈয়দ মুজতবা আলী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ইঙ্গিত করে উক্তিটি করেছেন।
‘বিশ্বকর্মা মহাত্মা’ মাত্র কয়েকটি শব্দ আর একটুখানি সুর দিয়ে মানুষকে দেবতা { বানিয়ে, আবার তাকেই দেবতার চেয়েও মহত্তর মানুষ করে তুলতে পারেন।
আরও পড়ুন – আজব শহর কলকেতা প্রশ্ন উত্তর