ডাইনিবিদ্যার অবসানে চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের ভূমিকা সম্পর্কে লেখো

ডাইনিবিদ্যার অবসানে চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের ভূমিকা সম্পর্কে লেখো

ডাইনিবিদ্যার অবসানে চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের ভূমিকা সম্পর্কে লেখো
ডাইনিবিদ্যার অবসানে চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের ভূমিকা সম্পর্কে লেখো

ডাইনিবিদ্যার অবসানে সম্ভবত তীব্র ধর্মীয় ভাবাবেগ ছিল সবচেয়ে বেশি দায়ী। খ্রিস্টানরা মনে করত যে, ডাইনিরা হল ঈশ্বরবিরোধী ও শয়তানের উপাসক। ফলে ডাইনিবিদ্যার অবসানে ইউরোপে চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা বিশেষভাবে তৎপর হয়েছিল।

ডাইনিবিদ্যার অবসানে চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের ভূমিকা

(1) চার্চের প্রাথমিক বিরোধিতা: ডাইনিবিদ্যা প্রাচীন প্যাগান ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সামগ্রিকভাবে ডাইনিবিদ্যা বা Witchcraft ছিল খ্রিস্ট ধর্মের মূল ধারণার বিরোধী। ডাইনিবিদ্যায় স্বর্গ-মর্ত্য ও পরকালের ধারণার অস্তিত্ব থাকলেও এই বিদ্যা পুরোহিততান্ত্রিক নয় বলেই খ্রিস্টান চার্চের কাছে তা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভেষজ ঔষধি, টেলিপ্যাথি (Telepathy), ফেইথ হিলিং (Faith Healing), প্রিকগনিশন (Precognition), ক্লেয়ারভয়েন্স (Clairvoyance), অ্যাস্ট্রাল ট্রাভেলিং (Astral Travelling), ক্রিস্টাল বল (Crystal Ball) ইত্যাদির মতো খ্রিস্টবিরোধী বিষয়গুলি ডাইনিবিদ্যায় অপরিহার্য ছিল। ফলে কেবলমাত্র প্রার্থনায় বিশ্বাসী খ্রিস্টীয় চার্চ মনে করল যে, ডাইনিরা শয়তানের কাছ থেকে এই সকল গুপ্তবিদ্যা আয়ত্ত করছে। তারা তখন ভয় পেতে শুরু করল। এমনকি ভেষজ ওষুধ দিয়ে যেসকল ডাইনিরা মানুষের প্রাণ বাঁচাত, তাদেরও ভাবা হত চার্চের শত্রু। 

(2) পোপের দলগঠন: এই সময় ইউরোপীয় খ্রিস্টান চার্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, প্যাগান ধর্মের যে ব্যক্তিরা ডাইনি বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকবে তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। পোপ ডাইনিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান করার জন্য খ্রিস্টান মিশনারিদের নিয়ে দলও গঠন করেন। এই সময় স্প্যানিশ ধর্মগুরু আলফোনসো দ্য এস্পিনা (Alphonso de Espina) ফোর্টালিটিয়াম ফিদেই (Fortalitium Fidei) নামে একটি ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি মোট ১০টি প্রজাতির ১৩ কোটি শয়তানের উল্লেখ করেন।

(3) ডাইনিবিদ্যার অবসানে উদ্যোগ:

  • পোপের অধ্যাদেশ: ডাইনিদের খ্রিস্টান ধর্মবিরোধী কাজকর্ম বন্ধ করার উদ্দেশ্যে খ্রিস্টান চার্চের তরফ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট (Pope Innocent VIII) I পঞ্চদশ শতকে (১৪৮৪ খ্রিস্টাব্দ) তিনি পাপাল বুল (Papal Bull, Summis desiderantes affectibus) অধ্যাদেশ জারি করে ডাইনিদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলে এবং তার পাশাপাশি অশুভ কাজকর্ম, ভয়ংকর মন্ত্রতন্ত্র ও পৈশাচিক আচরণের ফলস্বরূপ শাস্তি দেওয়ার বিধান বলবৎ রাখলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
  • গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশ: এর কিছু সময় পরে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে হেইনরিখ ক্রেমার (Heinrich Kramer) নামে এক ধর্মসভার বিচারক ম্যালিয়াস মেলফিকারম (Malleus Maleficarum) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থটিতে ডাইনিবিদ্যা বিলুপ্তিকরণ সম্পর্কে নানা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চার্চ থেকে এই বই বিপুল পরিমাণে ছাপিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমেও বলা হয় যে, শয়তানের সহচর-সহচরী ডাইনিরা তার নির্দেশেই পাপ কাজে লিপ্ত হয়েছিল।

(4) খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা: ইউরোপে খ্রিস্টীয় মঠের সন্ন্যাসীরা খ্রিস্টানবিরোধী সকল মানুষকে ডাইনি বলে সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এই খ্রিস্টানবিরোধীরা হেরেটিক্স (Heretics) নামে পরিচিত হন। এদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য উত্তর ইউরোপে যাজকীয় বিচারসভা (Papal Inquisition) প্রতিষ্ঠিত হয়। ডাইনি বিচার (Witch Trial) ও নিধনকার্যে এই বিচারসভার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন একজন প্রধান বিচারক, কয়েকজন বিচারক, কিছু অনুসন্ধানকারী, নিগ্রহকারী প্রমুখ। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট বিচারকদের ধর্মীয় আইনবলে ডাইনি সাব্যস্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার ক্ষমতা প্রদান করেন। শাস্তিযোগ্য অপরাধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- গোপন ডাইনিসভা করা, শয়তানকে আহ্বান করা, শিশুবলি দেওয়া, নরমাংস খাওয়া ইত্যাদি। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট তাঁর নির্দেশনামায় (Papal Bull) ইউরোপের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে খ্রিস্টীয় চার্চকে রক্ষার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপরেই যাজক শ্রেণি পূর্ণ উদ্যমে ডাইনি-নিধনে নেমে পড়েন।

(5) ডাইনিদের কঠোর শাস্তিদান ও হত্যা: সারা ইউরোপ জুড়ে ধর্মের চাদরের আড়ালে Witch-Hunt-এর নামে শুরু হয় অবর্ণনীয় বর্বরতা এবং হত্যালীলা। ডাইনিদের সমস্ত প্রকার অপরাধের শাস্তি ছিল নৃশংস নির্যাতন। ডাইনি-নিধনে প্রাচীন কালে এক ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার করা হত। এক সুতীক্ষ্ণ যন্ত্র ডাইনির বুকে বিঁধিয়ে দেওয়া হত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাইনিদের আগুনে পুড়িয়ে মারার কথা জানা যায়। ডাইনিদের বিচারসভায় বিচারের নামে চলে প্রহসন।

মূল্যায়ন

অতএব বলা যায়, চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা ডাইনিবিদ্যার অবসানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। হাজার হাজার ডাইনি-নিধনের মাধ্যমে তারা ডাইনিবিদ্যার অবসান ঘটানোকে পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করত।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment