কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’-এ রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা ব্যাখ্যা করো

কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’-এ রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা ব্যাখ্যা করো

অথবা, রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’-এ কী অভিমত ব্যক্ত করেছেন

কৌটিল্য 'অর্থশাস্ত্র'-এ রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা ব্যাখ্যা করো
কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’-এ রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা ব্যাখ্যা করো

ভূমিকা

প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহু মূল্যবান গ্রন্থ হল কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ড. শ্যাম শাস্ত্রী সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। এই গ্রন্থটির রচয়িতা সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ পণ্ডিত মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্যকেই অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা বলে স্বীকার করেছেন। তবে পণ্ডিতদের অনুমান বিভিন্ন যুগে গ্রন্থটি নানাভাবে পরিমার্জিত হয়েছে। অর্থশাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তু রাষ্ট্রনীতি হলেও এই গ্রন্থটিতে মৌর্য যুগ তথা প্রাচীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি অন্যান্য বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা

অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিকগুলি হল-দীপাশা

(1) শক্তিশালী ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র: অর্থশাস্ত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না-থাকলেও কৌটিল্য মূলত শক্তিশালী ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, রাজা উচ্চবংশজাত হওয়াই ব্যঞ্ছনীয়। কেন-না বংশকৌলীন্যের কারণে সহজেই তিনি প্রজাসাধারণের আনুগত্য ও ভক্তিশ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।

(2) রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব: কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র‘-এ বলা হয়েছে যে, মানবদেহের ন্যায় রাষ্ট্রেরও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্র মূলত সাতটি অঙ্গ দ্বারা গঠিত। এগুলি হল- (i) স্বামী (রাজা), (ii) অমাত্য (আমলা গোষ্ঠী), (iii) জনপদ (রাষ্ট্র), (iv) দুর্গ (পুর-নগর), (v) কোশ (অর্থভাণ্ডার), (vi) দণ্ড (শাস্তিবিধান), এবং (vii) মিত্র (বন্ধু রাজা বা রাষ্ট্র)। এই সাতটি অঙ্গ রাষ্ট্রের ‘সপ্তাঙ্গতত্ত্ব’ নামে পরিচিত।

(3) রাজার ক্ষমতা: কৌটিল্যের মতে, রাজা হলেন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। অর্থাৎ তিনিই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর কর্তৃত্ব ও আদেশকে উপেক্ষা বা অমান্য করার ক্ষমতা কারও নেই। তিনি রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক শাসন এবং বিচারব্যবস্থার প্রধান। তবে অর্থশাস্ত্রে তাঁর অবাধ ও স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে অবশ্য স্বীকার করা হয়নি। অর্থশাস্ত্রে, তাঁর সীমাহীন ক্ষমতার ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথাও বলা হয়েছে। কৌটিল্যের মতে, রাজাই রাষ্ট্র নয়, তিনি এর অংশমাত্র।

(4) রাজার কার্যাবলি : কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাজার গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যথা- (ⅰ) কৌটিল্যের মতে, রাজার প্রধান কর্তব্য হল প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা। (ii) বহিঃশত্রুর আক্রমণ, নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রোগ-ব্যাধি, দস্যু-দুষ্কৃতীদের হাত থেকে প্রজাদের নিরাপত্তা বিধান করা। (iii) রাজার অন্যতম কাজ হল একটি সৎ ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা। (iv) শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাজাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। (v) বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে দুর্গ ও নগর নির্মাণ করা।

(5) রাজার গুণাবলি: কৌটিল্যের মতে, রাজাকে হতে হবে কূটনীতিপরায়ণ। সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই রাজার মধ্যে থাকতে হবে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কর্মপ্রেরণা। রাজাকে হতে হবে সাহসী, ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপরায়ণ, দৃঢ়চেতা, বিচক্ষণ ও সংযমী।

(6) সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠন: কৌটিল্যের মতে, রাজার একার পক্ষে রাষ্ট্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এজন্য তিনি বিভিন্ন মন্ত্রী, অমাত্য ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের নিয়োগ করবেন এবং আমলাতন্ত্রের সাহায্যে রাজা শাসন পরিচালনা করবেন।

(7) প্রজাকল্যাণকর রাষ্ট্র: কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’-এ প্রজাকল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, রাজাকে হতে হবে প্রজাদরদি। প্রজাসাধারণের মঙ্গলসাধন করাই তাঁর অন্যতম প্রধান কর্তব্য। নিজের সুখের থেকেও প্রজার সুখ রাজার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, “প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার হিতে (মঙ্গল) রাজার হিত” (প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম্)।

(8) বিচার ও আইনব্যবস্থা: রাজাই হলেন রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের সর্বেসর্বা। রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীকে দণ্ড বা শাস্তিদান করা রাজার অন্যতম কর্তব্য বলে কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রণয়ন ও দণ্ডদানের পক্ষেই তিনি মত দিয়েছেন।

(9) রাজস্বব্যবস্থা : কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে বলেছেন যে, সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনার জন্য রাজকোশ সমৃদ্ধ হওয়া দরকার। কেন-না, দুর্বল বা শূন্য রাজকোশ রাজা ও প্রজার উভয়েরই দুর্গতির অন্যতম মূল কারণ। তাই রাজস্ব নির্ধারণ, রাজস্ব সংগ্রহ ও বৃদ্ধির ব্যাপারে রাজাকে সর্বদাই নজর রাখতে হবে। রাষ্ট্রের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য রাজাকে কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। অর্থশাস্ত্রে তিনি সীতা, ভাগ ও বলি নামে তিনপ্রকার করের কথা উল্লেখ করেছেন।

(10) গুপ্তচর ব্যবস্থা: মৌর্য শাসনব্যবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে কৌটিল্য গুপ্তচর ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। কৌটিল্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও বাইরে নানা খবরাখবর সংগ্রহের জন্য রাজাকে গুপ্তচর নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।

(11) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা: কৌটিল্য রাষ্ট্রের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় বিষয়ে পুরোহিতের কর্তৃত্বকে কৌটিল্য মেনে নিলেও রাজার ক্ষমতাকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পুরোহিতের নেই। এমনকি পুরোহিত অপরাধ করলে তিনি তাঁদের চরম শাস্তির বিধান দিয়েছেন। বিচারক ও রাজকর্মচারীদের নিয়োগের আগে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে যাচাই-এর পরামর্শ দিয়েছেন।

মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায় যে, মৌর্য যুগ তথা প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি চর্চার সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। এই গ্রন্থে প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত নানা বিধিব্যবস্থা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক আলতেকর বলেছেন যে, কৌটিল্য রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। আবার অনেকে মনে করেন, আধুনিক রাষ্ট্রনীতি চর্চায় ম্যাকিয়াভেলির যে স্থান, প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রনীতি চর্চায় কৌটিল্যের স্থানও অনুরূপ। তাই কৌটিল্যকে অনেকেই ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ বলে অভিহিত করেন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment