কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে রাজার ক্ষমতা, গুণাবলি এবং কার্যাবলি সম্পর্কে কী জানা যায়

কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে রাজার ক্ষমতা, গুণাবলি এবং কার্যাবলি সম্পর্কে কী জানা যায়

কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র' থেকে রাজার ক্ষমতা, গুণাবলি এবং কার্যাবলি সম্পর্কে কী জানা যায়
কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে রাজার ক্ষমতা, গুণাবলি এবং কার্যাবলি সম্পর্কে কী জানা যায়

ভূমিকা

মৌর্য যুগ তথা প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি, সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বা বহু মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থটি হল অর্থশাস্ত্র। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, এই গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন কৌটিল্য, যিনি চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত। এই গ্রন্থটির প্রকৃত রচয়িতা ও রচনাকাল সম্পর্কে নানা বিতর্ক থাকলেও এটি যে প্রাচীন ভারতের রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক একটি বহু মূল্যবান গ্রন্থ এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। এই গ্রন্থে রাষ্ট্রনীতি আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি রাজার ক্ষমতা, গুণাবলি ও কার্যাবলি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন।

(1) রাজার ক্ষমতা

‘অর্থশাস্ত্র’-এ রাজতন্ত্রকেই আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে রাজার ক্ষমতা, গুণাবলি ও কার্যাবলি সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হল-

  • রাজার চূড়ান্ত/সর্বময় ক্ষমতা: ‘অর্থশাস্ত্র’-এ বলা হয়েছে যে রাজা হলেন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রে তাঁর কর্তৃত্বকে উপেক্ষা বা অমান্য করার ক্ষমতা কারও নেই। তিনি সকল আইনের ঊর্ধ্বে এবং চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর নামেই রাষ্ট্রে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। রাজাই হলেন রাষ্ট্রের শাসন, আইন ও বিচার বিভাগের সর্বেসর্বা।
  • সামরিক ক্ষমতা: কৌটিল্যের মতে, রাজা হলেন রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সর্বেসর্বা। তাই অন্য রাজা বা রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কিংবা শান্তিস্থাপনের ব্যাপারেও তিনি চূড়ান্ত ক্ষমতা ভোগ করেন।
  • নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা: রাজা রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হলেও অর্থশাস্ত্রে তাঁর অবাধ ও স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে অবশ্য স্বীকার করা হয়নি। বরং তাঁর ক্ষমতার ওপর কৌটিল্য কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, রাজার স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার পথে প্রধান বাধাগুলি হল-বিভিন্ন প্রাকৃতিক আইন, ধর্মীয় অনুশাসন, প্রাচীন ঐতিহ্য প্রভৃতি। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজার একার পক্ষে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা সম্ভব নয়। এজন্য তিনি মন্ত্রীমণ্ডলীর সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করবেন। তবে রাজা তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য নন।

(2) রাজার গুণাবলি: অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য রাজার চারটি বিশেষ গুণ থাকা দরকার। এগুলি হল-

  • উত্থান গুণ: অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই রাজার মধ্যে থাকতে হবে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কর্মপ্রেরণা। এই উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে রাজার সকল কাজে নিযুক্ত থাকার গুণই হল উত্থান গুণ। তাঁর মতে, রাজার এই উত্থান গুণ কর্মচারীদের মধ্যেও সঞ্চারিত হলে প্রশাসন হবে গতিশীল।
  • অভিগামিক গুণ: ‘অর্থশাস্ত্র’ মতে, ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মপরায়ণতা (নম্রতা), শত্রু দমনে দক্ষতা ইত্যাদি গুণাবলি হল রাজার অভিগামিক গুণ। রাজার এই মহৎ গুণগুলি প্রজাদের রাজার প্রতি আকৃষ্ট ও অনুগত হতে সাহায্য করে।
  • ব্যক্তিগত গুণ: ব্যক্তিগতভাবে রাজাকে হতে হবে দৃঢ়চেতা, সংযমী, ধীরস্থির, বাক্সটু এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এগুলি হল রাজার ব্যক্তিগত গুণ।
  • প্রজ্ঞাগুণ: অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজার প্রজ্ঞাগুণ থাকা জরুরি। তীক্ষ্ণ মেধা, বিচক্ষণতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি, দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রভৃতি গুণগুলি হল রাজার প্রজ্ঞাগুণ।

(3) রাজার কার্যাবলি: ‘অর্থশাস্ত্র’-এ কৌটিল্য রাজার গুরুত্বপূর্ণ নানা কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যথা- ভাসি

  • প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা : কৌটিল্যের মতে, রাজার প্রধান কর্তব্য হল প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা।
  • নিরাপত্তা বিধান: কৌটিল্যের মতে, রাজার অপর আর-এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল প্রজাদের নিরাপত্তা বিধান করা। বহিঃশত্রুর আক্রমণ, নানা রোগ-ব্যাধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দস্যু বা দুষ্কৃতীদের হাত থেকে প্রজাসাধারণকে রক্ষা করার দিকে রাজাকে সদাসতর্ক থাকতে হবে।
  • প্রজাকল্যাণ: কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে বলেছেন, রাজাকে হতে হবে প্রজাকল্যাণকামী। তাঁর মতে, রাজাকে প্রতিটি মুহূর্তে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও প্রজাকল্যাণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। তিনি বলেছেন, “প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার হিতে (মঙ্গল) রাজার হিত”।
  • রাজকর্মচারীর নিয়োগ: কৌটিল্য বলেছেন, “সহায়সাধ্যাং রাজত্বম্”। অর্থাৎ রাজা রাজপুরুষ বা কর্মচারীদের সহায়তাতেই রাজত্ব করতে পারেন। তিনি শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে মন্ত্রী বা অমাত্য, পুরোহিত, বিচারক, গুপ্তচর সহ বিভিন্ন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের নিয়োগ করেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি যোগ্যতাকেই অগ্রাধিকার দেবেন।
  • বিচারকার্য পরিচালনা: রাজাই হলেন রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের প্রধান। কৌটিল্যের মতে, অপরাধীকে দণ্ড বা শাস্তিদান করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। 
  • রাজস্ব আদায়: অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, দুর্বল বা শূন্য রাজকোশ রাষ্ট্রের দুর্গতির অন্যতম মূল কারণ। তাই রাজাকে রাজস্ব সংগ্রহ ও বৃদ্ধির ব্যাপারে সর্বদা নজর দিতে হবে।
  • অন্যান্য কার্যাবলি : উক্ত কার্যাবলিগুলি ছাড়াও রাজার আরও অন্যান্য কার্যাবলির কথা অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল যুদ্ধ পরিচালনা করা, গুপ্তচর-এর মাধ্যমে রাজ্যের খবরাখবর সংগ্রহ করা ইত্যাদি।

মূল্যায়ন

পরিশেষে বলা যায় যে, কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি কেবলমাত্র প্রাচীন ভারতের ক্ষেত্রেই নয়, সর্বকালের সর্বযুগের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত তাঁর পরামর্শগুলি আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। অধ্যাপক আলতেকর বলেছেন, কৌটিল্যের পরবর্তীকালে অর্থশাস্ত্রের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত কোনো রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গ্রন্থ আজও রচিত হয়নি।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment